নোয়াখালী সদর উপজেলার সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি মো. আব্দুস শহীদকে (৪৩) গণপিটুনির নাটক সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা গেছে, মারধরে অংশ নেওয়া লোকজন ওই এলাকার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। তাদের সঙ্গে শহীদের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপ দিতেই এটিকে গণপিটুনি হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল।
শনিবার বিকালে নোয়াখালী সদর উপজেলার ১৯ নম্বর চর মটুয়া ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণবহর গ্রামে শহীদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত আব্দুস শহীদ ওই গ্রামের মমিন উল্যাহর ছেলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুস শহীদের কাছে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। সেইসঙ্গে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের পাইকারি বিক্রেতা। তার তিন সহযোগী রয়েছেন। এমন খবর ছড়িয়ে কয়েকজন এলাকাবাসীকে নিয়ে চার জনকে আটক করে পিটুনি দিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় চার জনকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাত ৮টার দিকে শহীদের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান নুরুল ইসলাম ওরফে মিয়া মাঝির নেতৃত্বে শহীদকে একটি পাকা দালানের কক্ষে আটকে রেখে পেটানো হচ্ছে। মিয়া মাঝির উপস্থিতিতে শহীদকে পেটাতে ও লাথি দিতে একাধিক তরুণকে দেখা গেছে।
ব্যাপক মারধরের পর হামলাকারীরা অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকের নাটক সাজান এবং গণপিটুনির বিষয়টি প্রচার করেন। রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হলে পুলিশও তখন আট মামলার পলাতক আসামির মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়। নিহত শহীদ যে যুবলীগের নেতা ছিলেন, বিষয়টি তখনও জানায়নি পুলিশ।
রাতে পিটুনির ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর রবিবার দুপুরে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর জাহেদুল হক বলেন, শহীদকে মারধরের ভিডিও আমি দেখেছি। এতে মিয়া মাঝি, তার ছেলেসহ কয়েকজনকে শহীদকে মারধর করতে দেখা গেছে। তবে ওই ভিডিও গতকালের কিনা, তা পরিষ্কার নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, তাদের মধ্যে আগেও ঝামেলা হয়েছিল।
শহীদের এলাকার বাসিন্দারা জানান, মিয়া মাঝির সঙ্গে শহীদের বিরোধ পুরোনো। মিয়া মাঝি এলাকায় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন। অপর দিকে শহীদের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। শহীদ পূর্ব চর মটুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারী ছিলেন। তার প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াতেন। বিগত নির্বাচনে নুরুল আমিন পরাজিত হলে শহীদ দুর্বল হয়ে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক ও মাদক ব্যবসার বিরোধের জেরে বছরখানেক আগেও শহীদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন মিয়া মাঝির লোকজন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ওই হামলার ঘটনায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান শহীদ। কিন্তু তাদের মধ্যকার বিরোধ থেকে যায় আগের মতোই। যার জের ধরে শনিবার বিকালে মিয়া মাঝির নেতৃত্বে তার ছেলে ও অন্যরা বাড়ির পাশ থেকে শহীদকে তুলে নিয়ে যান। এরপর একটি পাকা দালানের ভেতর একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। একই সময় মারধর করা হয় শহীদের অনুসারী আরও তিন জনকে। এরপর মিয়া মাঝির লোকেরাই থানায় ও যৌথ বাহিনীর কাছে ফোন করে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকের নাটকের খবর দেন। পরে তাদের নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়া মাঝি একসময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। তিনি বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। আর নিহত শহীদ ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিয়া মাঝির নেতৃত্বে স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তোফায়েল আহমদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। দফায় দফায় হামলার একপর্যায়ে তোফায়েল এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান।
শহীদকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন মিয়া মাঝি ও তার বাহিনীর সদস্যরা। লক্ষ্মীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মিয়া মাঝি, শহীদ বাহিনীসহ ওই এলাকায় আরও কয়েকটি ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপগুলো এলাকায় মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ভূঁইয়া বলেন, ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি আব্দুস শহীদ ব্যক্তি হিসেবে খারাপ হতে পারেন। অন্যায় থাকলে আইনের হাতে সোপর্দ করা যেতো। তা না করে এভাবে পিটিয়ে মারা হলো কোন যুক্তিতে? আবার পিটিয়ে হত্যা করে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজানো হলো।
৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর আমার বাড়িতেও হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছেন মিয়া মাঝি। ঘর থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছেন। ওই ঘটনায় আদালতে মামলা করায় এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি।
সুধারাম থানার ওসি জাহেদুল হক বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদের মৃত্যু হলেও রবিবার বিকাল পর্যন্ত তার পরিবারের কেউ থানায় যোগাযোগ করেননি। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ জানায়, শনিবার বিকালে পূর্ব চরমটুয়া এলাকায় শহীদ নামে এক অস্ত্রধারী ও তার অপর তিন সহযোগীকে আটক করা হয়েছে বলে যৌথ বাহিনীর কাছে খবর পাঠান স্থানীয় বাসিন্দারা। এই চার জন হলেন আব্দুস শহীদ, মো. জামাল, মো. জাবেদ ও মো. রিয়াদ। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ১৬ রেজিমেন্ট আর্টিলারি ক্যাপ্টেন ইফতেখার আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে স্থানীয় জনতার হাতে আটক ওই চার ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ সময় একটি শটগান জব্দ করা হয়। যৌথ বাহিনী আহত চার জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৮টার দিকে শহীদ মারা যান। অন্য তিন জন একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
আরও পড়ুন: নোয়াখালীতে পিটিয়ে চার জনকে যৌথ বাহিনীর হাতে সোপর্দ, একজনের মৃত্যু