প্রস্থানে আবদুল কাদের: ‘ইত্যাদি’র ২৫ বছরের ধারাবাহিকতায় ইতি

‘ইত্যাদি’র সেটে আবদুল কাদেরের শেষ শুটিংকাদের ভাই আমাদের ‘ইত্যাদি’ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। তাও এক দুই বছর না। এক দুটি কাজ নয়। টানা ২৫ বছর তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন ধারাবাহিকভাবে। এমনকি তার জীবনের শেষ শুটিংটাও করেছেন আমার সঙ্গে।
ফলে তার এই হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুবই বেদনার। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন সৎ অভিনেতা আর পরম বন্ধুকে হারালাম। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বড় ক্ষতি হলো, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিন দশকের সম্পর্ক আমাদের। প্রথম দিকে ‘ইত্যাদি’তে অনিয়মিত হলেও, শেষের ২৫টা বছর টানা তিনি কাজ করেছেন এই শোতে। এর পেছনে প্রধান কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের চেয়ে উনার বেশি। কারণ, একটি চরিত্র যদি আমরা দীর্ঘসময় টেনে নিতে চাই পর্দায়, তবে সেটার জন্য ঐ শিল্পীর কমিটমেন্ট-সময়ানুবর্তিতা-সততার প্রয়োজন পড়ে। তা না হলে এ ধরনের সিক্যুয়েল শো টানা যায় না। সেই বিবেচনায় কাদের ভাই আমার দেখা সবচেয়ে সচেতন শিল্পী, যার ওপরে নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়। যেটা ২৫ বছর ধরে আমি পেয়েছি। কারণ, তিনি লিকার চা ছাড়া কিছুই খেতেন না। তার মতো ছকে আঁকা জীবন খুব কম শিল্পীর মধ্যে দেখেছি।
এখন ভাবতেও খারাপ লাগে। কারণ, উনার যে ভেতরে ভেতরের শরীরের এই অবস্থা সেটা টের পাইনি। তিনি নিজেই টের পেতে দেননি। আমরা শেষ শুটিং করেছি ২২ সেপ্টেম্বর।
সেদিন দেখে মনে হলো, কাদের ভাই কেমন যেন শুকিয়ে গেছেন। চেহারা মলিন লাগছে। শুটিং করতে কষ্ট হচ্ছে। ডায়লগ আস্তে আস্তে বলছিলেন। তো আমি বললাম, ‘কাদের ভাই আপনাকে আরও জোরে বলতে হবে। অডিও পাচ্ছি না।’ কাদের ভাই বললেন, ‘জোরে তো আর বলতে পারবো না।’
এই কথা শুনে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। কারণ, ২৫ বছরে কোনোদিন যার মুখে ‌‘না’ শুনিনি, সেই মানুষটি এভাবে বলছে কেন!
কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম। আপনার শরীর খারাপ? তাহলে আজ বাদ দেন। বললেন, ‘একটু খারাপ। একটু। সমস্যা নাই আমি পারবো।’ যাই হোক, কাজটা শেষ করলাম। তিনি যাওয়ার সময় সবার সামনে থেকে আমার হাত ধরে ইউনিটের বাইরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘হানিফ ভাই আমার শরীরটা আসলেই ভালো না। আমার জন্য দোয়া কইরেন। যেন এই কাজটা নিয়মিত করতে পারি।’
হানিফ সংকেতওটাই সরাসরি শেষ দেখা ও কথা আমাদের। এরপর ভেলোরে যাওয়ার পর তার ছেলের মাধ্যমে ভিডিও কলে দেখলাম। সে দৃশ্যটা এত দ্রুত দেখবো ভাবিনি, খুব কষ্ট হয়েছে। কাদের ভাই, সেদিন খুব কেঁদেছেন বিছানায় শুয়ে। জড়ানো কণ্ঠে বলেছেন, ‘হানিফ ভাই আমার জন্য দোয়া কইরেন। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করবো।’
এরপর রেগুলার খোঁজ-খবর নিয়েছি শেষ দিন পর্যন্ত। কাদের ভাইরা হলেন এই ইন্ডাস্ট্রির শতভাগ খাঁটি মানুষ। এমন লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কী বলবো বেদনার কথা- এই অল্প সময়ে আমি হারিয়েছি দীর্ঘ জীবনের বেশ কয়েকজন গুণী মানুষকে। নাজমুল হুদা বাচ্চু, মহিউদ্দিন বাহার, কেএস ফিরোজ, এন্ড্রু কিশোর, এবার গেল কাদের ভাই। উনারা প্রত্যেকে ‘ইত্যাদি’ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। উনাদের আলোতেই ‘ইত্যাদি’ আলো ছড়িয়েছে নানা ভাবে, দশকের পর দশক।
তাঁদের হারিয়ে নিজেকে খুব একা লাগে এখন।
অনুলিখন: মাহমুদ মানজুর

আরও:
চলে গেলেন অভিনেতা আবদুল কাদের 

নব্বই দশকের ‘বদি ভাই’ থেকে এই দশকের ‘মামা’

প্রস্থানে আবদুল কাদের: মজনুর স্মৃতিতে বদি ভাই