‘জাওয়ান’ ঝড়ে পতিত প্রায় গোটা দুনিয়া। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা তো তুলকালাম। রোজ সেল রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছবিটি ১০ দিনে বক্স অফিস কালেকশন করেছে ৭০০ কোটি রুপির বেশি! অবশ্য ‘জাওয়ান’ ঝড় ওঠার আগেই ঢালিউডে বইছিল সেল রিপোর্ট প্রকাশের অভিনব প্রতিযোগিতা। দেশে বক্স অফিস কালচার না থাকলেও গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ ছবি দুটির সেল রিপোর্ট প্রকাশ হতে শুরু করলো নিয়মিত। যেন প্রতিযোগিতা লেগেছিল টিকিট সেল বা হল কালেকশনের খবর প্রকাশের। যেগুলো প্রচার করছিলেন খোদ সিনেমার নির্মাতা-প্রযোজক পক্ষ।
তখনই অবশ্য এসব হিসাব নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। চলেছিল দুই পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়িও। তবে সিনেমাকেন্দ্রিক এমন অতি বাণিজ্যিক সংস্কৃতিকে ভালো চোখে দেখছেন না দেশের বহুমাত্রিক সফল অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। মঞ্চ, টিভি আর ওটিটি বাদ দিলেও বড় পর্দায় যিনি বারবার প্রমাণ করেছেন ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’ আর ‘হাওয়া’ দিয়ে, নিজেকে। এই প্রমাণ যেমন গুণগত, তেমন বাণিজ্যিকও। যা দেশ ও বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে বারবার। সেই অভিনেতা এই সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ অস্বস্তি প্রকাশ করলেন ‘সেল রিপোর্ট’ প্রচারণা ইস্যুতে।
প্রশ্নটি ছিল ‘জাওয়ান’ দেখেছেন?
জবাবে বললেন, ‘‘না এখনও দেখিনি। টিকিট নিয়ে যে হাঙ্গামা চলছে। আরেকটু শান্ত হোক। তবে টিকিট ক্রাইসিস বিষয়টা আমার বরাবরই ভালো লাগে। অথবা হলের সামনে হাউজফুল সাইনবোর্ড দেখলেও আনন্দ লাগে। বলে রাখি, ‘পাঠান’ দেখার চেষ্টা করেছি। পুরোটা দেখতে পারিনি!’’
প্রথম গল্প প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হল বাঁচাতে হবে বা ইত্যাদি আলাপ আমি শুধু শুনি। কিছু আর বলতে ইচ্ছা করে না। আমার কথা স্পষ্ট, কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবে না। যতদিন না আমরা আমাদের নিজ নিজ কাজটা সঠিক ও সততার সঙ্গে করি। দেশীয় সিনেমার গল্প বা অভিনয় বা নির্মাণের বাইরে গিয়ে যেখানে আমরা টিকিট সেলের প্রচারণায় ডুবে যাই, সেখানে আসলে সিনেমা শিল্পটা বেঁচে থাকার কথা না। আর সিনেমা না বাঁচলে ওই হল বাঁচিয়ে বা দর্শক বাঁচিয়ে আপনি কী অ্যাচিভ করবেন? আমি যদি ইন্ডাস্ট্রিকে পাঁচটা ভালো কাজ না দিতে পারি, তাহলে চিৎকার করে হল বাঁচাও হল বাঁচাও বললে হল বাঁচবে? ভালো কাজের বিকল্প নাই। কাজ না করে চিৎকার করলে তো হবে না। আমরা এখন সেই কাজটাই করছি।’
এরপর এলো সেল রিপোর্ট প্রচারণা নিয়ে চঞ্চল চৌধুরীর বিস্তারিত ক্ষোভের আলাপ। শুরুটা করলেন ‘জাওয়ান’ দিয়েই। তবে বলতে বলতে ঢুকে পড়লেন দেশীয় সিনেমা শিল্পেও সেই আঁচের অশুভ উদাহরণ দিয়ে।
তিনি বলেন, ‘একটা কথা বলি। ছবির প্রচার-প্রচারণা এখন এমন জায়গায় গেছে, প্রতিদিন দেখি টাকার আপডেট! এটা পণ্য নাকি শিল্প? এখন দেখি অর্থ দিয়ে মাপা হচ্ছে প্রতিটা ছবি। কোন ছবির বাজেট কতো। কোন শিল্পীর সম্মানি কতো বেশি। কোন সিনেমার টিকিট সেল কতো। কোন ছবি টিকিট বেচে সব ইতিহাস ভেঙে দিলো। এসব! এটা ঠিক, একটা ছবি করলে সেটার লগ্নি ফেরত আসতে হবে। ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু ছবিটা ভালো না মন্দ, সেটা কেন মাপা হবে টিকিট বিক্রি দিয়ে? শিল্প তো ভালো হবে, না হয় মন্দ। এটার আবার সেল রেকর্ড কী? আমার তো এমন কিছু জানা নেই। এখানে এখন, সিনেমাটা ভালো কি মন্দ সেটা বিষয় না। বিষয় হলো কতো সেল করলো। আরও হতাশার বিষয়, এই টাকার অঙ্কটা যদি প্রপার হতো। দেশের ক্ষেত্রে যেটা হয় বেশিরভাগই ফেক নিউজ। মানে এই টাকার হিসাবে গরমিল আছে। এটা করাই হচ্ছে দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য। যেখানে সিনেমার গুণাগুণ তো নেই বরং আছে মিথ্যা প্রচারণা।’
বলা হচ্ছিলো, শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ ছবিটি বাংলা সিনেমার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সুপটারহিট ছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে। কাছাকাছি আলাপ চলছিল আফরান নিশোর ‘সুড়ঙ্গ’ নিয়েও। দেশে ছবিটি হিট হলেও আশাতীত মুখ থুবড়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। দুটো ছবিই তিনি দেখেছেন আগ্রহ নিয়ে। তবে এসব বিষয়ে একদমই মন্তব্য করতে প্রস্তুত নন চঞ্চল চৌধুরী। বরং তার চিন্তা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আগামীর ঢালিউড।
তার মতে, ‘‘এখন যদি বলা হয় অমুক ছবি বাংলা সিনেমার সব রেকর্ডে ভেঙে দিয়েছে, ল্যান্ডমার্ক হয়ে গেছে বা অমুক সিনেমা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে; তো যে ছেলেটা বা মেয়েটা নবজাতক হিসেবে সিনেমা করতে আসবে বা বানাবে, সে আসলে কাকে বা কোন ছবিটাকে অনুসরণ করবে? ‘হাওয়া’ অনুসরণ করবে? যে ছবিটি দেশ ও বিদেশে তুমুল প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে; একই সঙ্গে দারুণ টিকিট বিক্রি করেছে। নাকি শুধুই বিক্রি-বাট্টায় স্বঘোষিত ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করা ছবিটিকে ফলো করবে? আমরা তো তরুণ প্রজন্মের জন্য রুচির ঝামেলা করে ফেলেছি। এগুলো নিয়ে গভীর ভাবনার অবকাশ আছে।’’
‘সেজন্য বলছি, প্রমোশন অবশ্যই লাগবে। কিন্তু সেটির নামে আমরা আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছি—কতো সেল হলো সেটা। অথচ সেলওয়ালারা গল্প, নির্মাণ, অভিনয় নিয়ে কথা বলছে না। সেটা সম্ভবও না। কারণ, এখানে গল্পটা কোথায়? এই ছবিগুলোতে যে গল্প দেখি, আমাদের সমাজে সেটা কি এখনও এগজিস্ট করে? সেজন্যই বলছি, সিনেমা আর সিনেমার জায়গায় নেই। সিনেমার মান নির্ধারণ হয় কে কতো বিজনেস করলো, সেটা দিয়ে’—যোগ করলেন ‘পদাতিক’ অভিনেতা।
প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই, সদ্য নির্মিত ‘পদাতিক’ ছবিটি প্রসঙ্গেও খানিক আপডেট দেওয়া দরকার। চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত সর্বশেষ চমক হচ্ছে এই ছবিটি। যেখানে তিনি অভিনয় করেছেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নির্মাতা মৃণাল সেনের চরিত্রে। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন সৃজিত মুখার্জি। যে সিনেমার জন্য চঞ্চল চৌধুরী এরমধ্যেই শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন কিংবদন্তি অমিতাভ বচ্চনের পক্ষ থেকে।
শুধু যে ছেড়েই দিচ্ছেন, তাও কিন্তু নয়। ধরছেনও দারুণ সব কাজ। টলিউডের ‘পদাতিক’ ছবিটিকে বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলা সিনেমা হিসেবে। যার মূল চরিত্রে কাজ করেছেন ঢাকার চঞ্চল চৌধুরী। নতুন বছরের শুরুতে তেমনই টলিউডের আরেকটি আলোচিত ছবির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আভাস দিলেন অভিনেতা। যার প্রস্তুতি শুরু করেছেন এরইমধ্যে। যদিও নামটি বলছেন না। এটুকু বললেন, ‘ছবিটির সঙ্গে কলকাতার বড়সড় মানুষরাই থাকছেন। যাদের চলাচল বলিউড পর্যন্ত। এর বেশি কিছু এখনই বলছি না। আপাতত হাতের কাজগুলো শেষ করতে চাই। তারপর ছয় মাসের ডুব দেবো সেই কাজটির জন্য।’
আরও পড়ুন-
আমেরিকার বক্স অফিসে ‘দেবী’কে টপকে তৃতীয় ‘প্রিয়তমা’