বৃষ্টির পানি মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিন জনসহ চার জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর মিরপুর কমার্স কলেজের পাশে ঝিলপাড় বস্তির বিপরীতে এই দুর্ঘটনার পর আলোচনায় এসেছে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের বিষয়টি। ড্রেন ও রাস্তার নিচের কালভার্ট দিয়ে ঝিলপাড় বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধ এসব সংযোগের বিষয়ে আগেই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডকে (ডেসকো) মৌখিকভাবে অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেননি কর্মকর্তারা। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এই দায় বিদ্যুৎ বিভাগ এড়াতে পারে না বলেও দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে ডেসকো বলছে, যখনই কোথাও চোরাই লাইনের সন্ধান পাওয়া যায়, তখনই কর্মীরা গিয়ে তা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আসেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাই লাইনের বিষয়ে ডেসকোকে দুই বছর আগেই একবার মৌখিক অভিযোগ করেছিলেন তারা। তবে এরপর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ চক্রের রোষানলে পড়তে হয় তাদের। ঝিলপাড় বস্তিতে লাইলী, সুফি, শান্তি, মোমেন ও আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে মিরপুর ২ নম্বরের ডুইপ আবাসিক এলাকার বি ব্লকের ২ নম্বর লেনের একাধিক বিদ্যুতের খুঁটি থেকে সংযোগ নিয়ে বছরের পর বছর টাকা কামিয়েছে। চক্রটি ডেসকোর কর্মকর্তা, পুলিশ, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ করে’ এ ধরনের অবৈধ কাজ চালিয়ে আসছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চার জন পানিতে পড়েছিলেন, ঠিক তখনই বিষয়টি বুঝে পেরে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের অন্যতম হোতা লাইলী রাস্তার পাশে এসে বিদ্যুৎ সংযোগ খুঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তা না হলে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতো। পরদিন শুক্রবার (২২সেপ্টেম্বর) থেকে লাইলীসহ সুফি, শান্তি, মোমেন ও আলাউদ্দিনকে আর ঝিলপাড় বস্তির আশপাশে দেখা যায়নি। সবাই পালিয়েছে।
এ ঘটনায় শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) ‘অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু’র কথা উল্লেখ করে মিরপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত অনিকের বাবা। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে জানিয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ ঘটনায় অবহেলা কার কার ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একাধিক বার ডেসকোর কর্মকর্তাদের এই চোরাই লাইনের বিষয়ে জানানো হয়েছে। তারা এসে লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। তারা চলে যাওয়ার পর আবার সংযোগ লাগিয়ে দিতো অবৈধ সংযোগকারীরা। তারা যদি স্থায়ী কোনও সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে অবশ্যই এখানে কোনও চোরাই লাইন থাকতো না। এখানে বোঝাই যায় ডেসকোর লোকজনও এই চোরাই লাইনের সুবিধাভোগী।
চার জনের মৃত্যুর ঘটনার পর শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ডেসকোর লোকজন এসে ড্রেনের নিচ দিয়ে থাকা বিদ্যুতের লাইন অপসারণ করে। এই শিক্ষক বলেন, ‘এমন একটি ঘটনা ঘটার পর বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সজাগ হলো। চার জন মরার পরে তাদের বিবেকের উদয় হলো। দেখা যাক কত দিন এমনটা থাকে।’
মিরপুর-২ নম্বর ডুইপ আবাসিক এলাকার সেক্রেটারি এমএ হামিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই নম্বর রোডের বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ঝিলপার বস্তি এলাকায় চোরাই লাইন দেওয়া হয়েছে— এ বিষয়টি ডেসকো কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে একাধিকবার জানানো হয়েছিল। জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে দুই নম্বর রোডে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করে আমাদেরটি চার নম্বর রোডে স্থানান্তর করে দেওয়া হয়। বিদ্যুতের খুঁটি থেকে চোরাই লাইন নেওয়া হয়েছে; এ বিষয়টি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই জানতো। তারা একাধিকবার সংযোগ বিচ্ছিন্নও করেছে। কিন্তু এ ছাড়া তাদের আরও কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তারা চলে যাওয়ার পরেই আবার সেই একই অবস্থা চলতো। এসব বিষয় প্রতিবাদ করতে গেলে একাধিকবার বিভিন্ন লোকজনের রোষানলে পড়তে হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
চার মৃত্যুর জন্য দায়ী বিদ্যুতের ‘চোরাই লাইন’, ১০ লাখে দফারফার প্রস্তাব!