কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি, আশা ছাড়েনি পরিবার

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার আবেদন সরকার নাকচ করে দেওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বিএনপি ও তার পরিবার। পরবর্তী করণীয় হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে এগোনোর পরিকল্পনা শুরু হয়েছে বিএনপিতে। এরমধ্যে নতুন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি প্রদান, দেশে-বিদেশে চাপ প্রয়োগ ও সরকারের সঙ্গে পরিবারের আবারও যোগাযোগ করার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে আইনগতভাবে আর কোনও পথ বের করা যায় কিনা, সে দিকটিও বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।

রবিবার (১ অক্টোবর) বিকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদন গ্রহণ করার সুযোগ নেই। আমরা এ মতামত দিয়ে আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।’ বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়ায় দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আইনটাকে অপব্যাখ্যা করছেন। বিষয়টিকে আইনগতভাবে বিবেচনা করা হয়নি। সরকার রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করছে।’

এ পরিস্থিতিতে রবিবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপির নেতারা একমত হয়েছেন— সরকার কোনও অবস্থাতেই বিএনপির চেয়ারপারসনকে দেশের বাইরে যেতে দেবে না। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর বেশ কয়েকজন নেতা স্লো পয়জনিং করার অভিযোগ করেছিলেন— সে বিষয়টিও আজকের বৈঠকে আলোচনায় এসেছে। নেতারা মনে করেন, মূল বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই সরকার খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে যেতে দিচ্ছে না।

দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে উল্লেখ করেন, শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের পরই তারা স্পষ্ট হয়েছেন যে, সরকার খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে যেতে দেবে না। রবিবার আইনমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর বিষয়টিকে তারা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে নতুন করে কর্মসূচির দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন তারা।

হাসপাতালে খালেদা জিয়া (ফাইল ফটো)এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করছি, আমরা আন্দোলন করবো। আমাদের আর কী করার আছে। যুদ্ধ করতে পারবো না, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন করবো। এ বিষয়ে কর্মসূচি আসবে, ইনশাল্লাহ।’

বিএনপির প্রভাবশালী দায়িত্বশীলরা বলছেন, বেগম জিয়ার বিষয়ে সরকার শুরু থেকেই আন্তরিক ছিল বলে পরিবারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আবেদন করা হয়। রবিবার রাতে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২২ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী পাবলিকলি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন যে, খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করলে সরকার বিবেচনা করবে। এই জনপ্রকাশ্য আহ্বানের কারণেই কিন্তু ২৫ সেপ্টেম্বর ম্যাডাম জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার সাহেব আবেদন করেছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল— মূলত আইনমন্ত্রীর ২২ সেপ্টেম্বরের অন্তর্নিহিত ইতিবাচক মনোভাবের কারণে। আইনে কভার করে বলেই তো তিনি আবেদনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আইনমন্ত্রী তো তার কথার বরখেলাপ করেছেন। এটা প্রতারণা হয়েছে। আইনমন্ত্রী এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করেছেন।’

সরকারের ‘না’ ঘোষণার পর বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পরিবারের মধ্যে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়— প্রথমত, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতিশীল হওয়ায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দলে ও পরিবারে। চিকিৎসকদের মধ্যেও দুশ্চিন্তা কাজ করছে।

তবে পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তি বা যেকোনোভাবে বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, বলে উল্লেখ করেন পরিবারের সঙ্গে যুক্ত একজন।

দলের মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের ভাষ্য, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার অবনতির মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তে সবাই উদ্বিগ্ন হয়েছে।

উদ্বেগ ছড়ালেও নতুন আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে তৎপরতা শুরু করবে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো চলমান থাকায় ইস্যু যেন এককভাবে মানুষের সামনে থাকে, সে কারণে বেগম জিয়ার মুক্তি ও সরকারের পতনের বিষয়টিকে সমানভাবে মূল্যায়ন করার পক্ষে দলটির নেতারা। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে চলমান আন্দোলনের ইস্যুটিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা আছে বলে মনে করেন নেতারা। সে কারণে সরকার পতনের চলমান কর্মসূচি ও বেগম জিয়ার মুক্তির কর্মসূচিকে সমন্বিতভাবে সক্রিয় করার চিন্তাও চলছে তাদের মধ্যে।

স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, চলতি অক্টোবরেই সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি পালন করতে চায় বিএনপি। একইসঙ্গে খালেদা জিয়ার ইস্যুটিতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে দলীয়ভাবে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অনেকে মনে করেন, রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি মানানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলোই ভরসা। যদিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে খালেদা জিয়ার দ্বিমত থাকায় রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি কতখানি এগোবে, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিপির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া ম্যাডামের সঠিক ট্রিটমেন্ট হবে না। এটা তো সরকার সরাসরি না করেছে। দেশে-বিদেশের সবাই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন, সবাই জানে। উনাকে (বেগম জিয়াকে) তারা পরিকল্পিতভাবে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে ম্যাডামের কিছু হলে সব দায়-দায়িত্ব সরকারের। তাদের রেহাই পাওয়ার কোনও সুযোগ নাই।’

আমির খসরু আরও উল্লেখ করেন, আমাদের আন্দোলন কর্মসচি চলমান আছে। রাজপথে আবারও কর্মসূচি আসবে।

এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি। সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব না। তাকে বাঁচাতে হলে আন্দোলনে জয়লাভ করতে হবে। সেই আন্দোলনে আছি আমরা।’

তবে সরকারের পরামর্শ মেনে বিএনপি আবার আদালতে যাবে কিনা, এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটা আমরা ডিসাইট করিনি। আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।’

ব্যারিস্টার কায়সার কামালের মন্তব্য— ম্যাডাম তো আদালতের মাধ্যমে মুক্তি পাননি। তিনি সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়েছেন। প্রকাশ্যে বলার পর পরিবার আবেদন করেছে। তারা মঞ্জুর না করে আইনের অপব্যাখ্যা দিয়েছে। অপব্যাখ্যার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।’

আরও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার আবেদনে যে মত দিলেন আইনমন্ত্রী

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা, অভিযোগ কায়সার কামালের

শর্ত মেনে বিদেশ যেতে ‘রাজি নন’ খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে: বাংলা ট্রিবিউনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যুতে আদালতে যাবে না বিএনপি

ভালো নেই খালেদা জিয়া, বিদেশে নেওয়ার অনুমতির সম্ভাবনা ক্ষীণ

খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে আবারও চিঠি দেবে পরিবার