নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামই বাড়তির দিকে। রমজান আসার পর মুনাফাখোরদের তৎপরতা আরও বাড়ছে। এ নিয়ে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ, আরেকদিকে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে– নিত্যপণ্যের বাজার কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়? সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। বরং যে যার মতো করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম রাখছে। দাম বেঁধে দিয়ে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিনা সেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে গত ১৫ মার্চ ‘কৃষি বিপণন আইন ২০১৮’-এর ৪(ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে ২৯টি দেশি কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। বিজ্ঞপ্তিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত দামে এসব কৃষিপণ্য কেনাবেচার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নির্ধারিত মূল্য তিনটি ভাগে করা হয়েছে। পণ্যের উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
২৯টি পণ্যের মধ্যে আমদানিকৃত ছোলার উৎপাদক পর্যায়ে দাম ৯০ টাকা ৩৭ পয়সা, পাইকারি দাম সর্বোচ্চ ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ৯৮ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নত মসুর ডাল খুচরা পর্যায়ে ১৩০ টাকা ৫০ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১২৫ টাকা ৩৫ পয়সা; মুগডাল পাইকারি পর্যায়ে ১৫৮ টাকা ৫৭ পয়সা, খুচরা পর্যায়ে ১৬৫ টাকা ৪১ পয়সা; মাষকলাই ডাল পাইকারি পর্যায়ে ১৪৫ টাকা ৩০ পয়সা, খুচরা পর্যায়ে ১৬৬ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মসুর ডাল (মোটা) প্রতিকেজি পাইকারি ১০০ টাকা ২০ পয়সা, খুচরা পর্যায়ে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা; খেসারি ডাল পাইকারি ৮৩ টাকা ৮৩ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ৯২ টাকা ৬১ পয়সায় বিক্রির অনুরোধ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মাছের মধ্যে পাঙাশ মাছের (চাষের) পাইকারি দর ১৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১৮০ টাকা ৮৭ পয়সা; চাষের কাতল মাছ পাইকারি ৩০৩ টাকা ৯ পয়সা ও খুচরা ৩৫৩ টাকা ৫৯ পয়সা; গরুর মাংসের পাইকারি দর ৬৩১ দশমিক ৬৯ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ৬৬৪ দশমিক ৩৯ টাকা; ছাগলের মাংসের ক্ষেত্রে পাইকারি মূল্য ৯৯২ দশমিক ৫৮ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ১০০৩ টাকা ৫৬ পয়সায় বিক্রি করতে বলা হয়েছে অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।
ব্রয়লার মুরগি পাইকারি ১৬২ টাকা ৬৯ পয়সা, খুচরা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা; সোনালি মুরগি পাইকারি ২৫৬ টাকা ১০ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ২৬২ টাকা; ডিম প্রতি পিস বিক্রয় মূল্য ১০ টাকা ৪৯ পয়সা ও পাইকারি দর ৯ টাকা ৬১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেজি প্রতি দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দাম ৫৩ টাকা ২০ পয়সা ও খুচরা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ টাকা; প্রতিকেজি দেশি রসুন পাইকারি ৯৪ টাকা ৬১ পয়সা ও খুচরা ১২০ টাকা ৮১ পয়সা; আমদানিকৃত আদা পাইকারিতে ১২০ টাকা ২৫ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১৮০ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করেছে অধিদফতর। প্রতি কেজি শুকনো মরিচ পাইকারি পর্যায়ে ২৫৩ টাকা ২৬ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ৩২৭ টাকা ৩৪ পয়সা; কেজিপ্রতি কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা ২০ পয়সা খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে ৪৫ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতি পিস বাঁধাকপি পাইকারি ২৩ টাকা ৪৫ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ২৮ টাকা ৩০ পয়সা; প্রতি পিস ফুলকপি পাইকারি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা ও খুচরা ২৯ টাকা ৬০ পয়সা; খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি বেগুন ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সা ও সিম ৪৮ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রতিকেজি আলুর খুচরা মূল্য ২৮ দশমিক ৫৫ টাকা, টমেটো ৪০ দশমিক ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২৩ দশমিক ৩৮ টাকা, প্রতি কেজি জাহেদি খেজুর খুচরা পর্যায়ে ১৮৫ দশমিক শূন্য ৭ টাকা, মোটা চিড়া ৬০ টাকা কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। সাগর কলার হালি খুচরায় ২৯ দশমিক ৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বেসনের খুচরা দাম ১২১ দশমিক ৩০ টাকা বেঁধে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদফতর।
কিন্তু বাস্তবে বাজারে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কোনও প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। শনিবার ও রবিবার (১৬ ও ১৭ মার্চ) বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না কোনও পণ্য। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন বাজারের অধিকাংশ বিক্রেতা।
সরকার নির্ধারিত দাম অনুসারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৬৪ টাকার মধ্যে হওয়ার কথা। তবে রামপুরা বাজারে গরুর মাংস ৭৫০ টাকায়ই বিক্রি করতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, কে দাম ঠিক করে দিয়েছে কিছু জানি না। সমিতি থেকেও আমাদের কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে, কাওরান বাজারে সবজি, মাছ-মাংসসহ অন্য পণ্যের পাইকারি বাজারেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ নির্দেশনার কোনও প্রভাব পড়েনি। বাজারে সব পণ্যের দাম আগের মতোই চড়া। মাছের মধ্যে চাষের পাঙাশের খুচরা দাম ১৮১ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, সরকার এমন একসময় খেজুরের দাম নির্ধারণ করেছে, যখন রমজান শুরু হয়ে গেছে। তাতে বাজারে বেঁধে দেওয়া দামের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। শনিবার (১৬ মার্চ) মুদি দোকানে বেঁধে দেওয়া দামের তুলনায় প্রতি কেজি ছোলা ১২ টাকা, মসুর ডাল ১০ টাকা, খেসারি ১৭ টাকা বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে মাছ-মাংসসহ ২৯টি পণ্য।
রোজায় ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিতে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এই সুবিধার সুযোগ থাকবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য বাড়িয়ে ধরছে বলে এর প্রভাব পণ্যমূল্যে পড়ছে। এ কারণে সে ধরনের সুফল পাচ্ছে না।
শত উদ্যোগের পরেও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না, এক্ষেত্রে করণীয় কী তা জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হচ্ছে– দাম বেঁধে দিয়ে নয়, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।
এ প্রসঙ্গে আন্তসরকারি সংস্থা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিরডাপ) পরিচালক (গবেষণা) অর্থনীতিবিদ হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, দাম বেঁধে দিয়ে নয়, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে। এক্ষেত্রে বেশি দামের আশায় কেউ মজুত করলে তা রোধ করতে হবে। আর মজুত রোধ করতে যদি সরকারকে কঠিন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা নিতে হবে। সাধারণ মানুষকেও আতঙ্কিত হয়ে অধিক পরিমাণের পণ্য না কেনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, সরকার সব ধরনের নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কঠিন হতেও দ্বিধা করবে না।
টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও সরকার বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি কিনা এই প্রশ্নের জবাবে গত ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার ব্যর্থও না, জিম্মিও না। দেশটা অনেকের চেয়ে ভালো চলছে। বাজার পরিস্থিতি বিশ্বের কোথাও ভালো নেই। সস্তায় সুলভে সবকিছু এটা মনে করার কারণ নেই। সারা বিশ্বে বাজার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে তিনি আরও বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙবে। আসলে এর সঙ্গে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখার বিষয় আছে। যারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে, ক্ষমতায় যেতে হাহাকার করছে, এই সিন্ডিকেট তাদের হতাশা থেকে হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-
খলিল, খোরশেদ, নয়নরা পারলে বাকিরা পারবেন না কেন?
‘একটা মুরগি কেনার মুরোদ নাই, শার্ট-প্যান্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে’
স্বল্পমূল্যের কুলভ্যানে বেশি আগ্রহ গরু ও মুরগির মাংসে
কেউ পাচ্ছেন নিয়মের বেশি, কারও হাত শূন্য
কেন বাড়ছে দেশি-বিদেশি সব ফলের দাম?
৫০০ টাকার ওপরে কোনও খেজুরই আমদানি হয় না, বাজারে ২ হাজার
পাঁচ বছরে খেজুরের দাম বেড়েছে সাতগুণ
ইসবগুল কেন কেজিতে বাড়লো ৮০০ টাকা
১৪৫০ টাকার এলাচ ৩১০০ টাকায় বিক্রি