X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফিকে হয়ে আসছে ঢাকাই বেনারসির চাকচিক্য

জুবায়ের আহমেদ
১৪ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪৯আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২২, ১৫:৪৯

বাঙালি নারীর নিত্য অনুষঙ্গ শাড়ি। আর সোনালি জরিতে মোড়ানো কারুকার্যময় বেনারসি প্রত্যেক নারীর কাছেই আকাঙ্ক্ষিত। ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ির আদিস্থান ভারতের বেনারসে। বলা হয়, গুণগত মান আর চাকচিক্যময় ডিজাইনে একসময় বেনারসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল ঢাকাই বেনারসি। আর এই শাড়িকে কেন্দ্র করেই রাজধানীর মিরপুরে গড়ে উঠেছিল বেনারসি পল্লী। বেনারসির একসময়ের ব্যস্ত কারিগরদের এখন অলস সময় কাটে। শাড়ির চাহিদা কমায় কমেছে উৎপাদন। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারখানা।

বেনারসি শাড়ির উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, প্রতিবেশি দেশের শাড়ির প্রভাবে দেশীয় শাড়ির উৎপাদন ও বিপণন; দুটোই কমেছে। একসময় বেনারসি শাড়ি তৈরিতে কাজ করতো লাখের উপর কর্মী। সেখানে এখন কর্মরত রয়েছেন মাত্র হাজার তিনেক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে বেশ কিছু মুসলিম পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাদের মধ্যেই হারুন শেঠ নামে এক ব্যবসায়ী প্রথম বেনারসি তাঁত সামগ্রী আমদানি শুরু করেন। তারই হাত ধরে শুরু হয় মিরপুরে বেনারসি শিল্পের যাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীর বাব্বন শেঠ, কাজিম শেঠ, সুল্লিদা, বেলাল আহমেদ, হানিফসহ অনেক এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

ফিকে হয়ে আসছে ঢাকাই বেনারসির চাকচিক্য

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আটকেপড়া পাকিস্তানিদের একটি অংশ মিরপুর ১০, ১১ ও ১২ এর বিভিন্ন স্থানে রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা শুরু করে। পেশা হিসেবে তাদেরও অনেকেই বেনারসি শাড়ি তৈরি ও কারচুপির কাজ বেছে নেন। তাদেরই প্রচেষ্টায় মিরপুরের বেনারসি জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে অনেক বাঙালিও এই পেশায় যুক্ত হন।

দেশ স্বাধীনের পর এ শিল্পের প্রসার ঘটেলেও আশির দশকের শেষের দিক থেকে দেশ ও দেশের বাইরে মিরপুরের তৈরি বেনারসি শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কয়েক দশক রাজত্ব করা দেশীয় বেনারসি শিল্প এখন ধুকছে।

বেনারসি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ভারতীয় শাড়ির দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি কারিগরের অভাবেও ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে বেনারসি তৈরির কারখানাগুলো। এছাড়াও বেনারসি শাড়ি বুনতে যে সিল্কের জরি বা সুতা ব্যবহার করা হয় তা চীন থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে সেই সিল্ক সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ি তৈরিতেও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একই মানের ভারতীয় বেনারসি থেকে দেশীয় বেনারসির দাম আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে।

কারিগরদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বাব্বন শেঠের কারখানার জ্যেষ্ঠ কারিগর মোহম্মদ মোস্তফার সঙ্গে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই কাজের সাথে জড়িত মোস্তফা জানান, 'বাব্বন শেঠ মিরপুরের প্রসিদ্ধ বেনারসি ব্যবসায়ী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর সেই ব্যবসার হাল ধরেন তার দুই পুত্র। কিন্তু বর্তমানে ঠিক মত কাজের অর্ডার না পাওয়ায় এই ব্যবসার প্রতি তেমন আর আগ্রহ নেই তাদের। কারখানায় ১৮টা শাড়ী বোনার মেশিন থাকলেও এখন মাত্র ১২টি সচল আছে।'

স্থানীয় বেনারসি তৈরির ব্যবসার দুরবস্থার জন্য দেশের বাজারে ভারতীয় বেনারসি শাড়ির প্রভাবকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আমরাও খুব চেষ্টায় আছি এই কাজ থেকে বের হয়ে যাওয়ার। দেশে এখন সব জায়গায় ভারতের শাড়ি পাওয়া যায়। ওই শাড়িগুলো মেশিনে বানানো হয়, সেকারণে দামও কম। কিন্তু আমরা তো হাতে বানাই, পরিশ্রম বেশি। তাই দামটাও একটু বেশি।’

ফিকে হয়ে আসছে ঢাকাই বেনারসির চাকচিক্য

এই কারিগর ব্যাখ্যা করে বলেন, মেশিনে একজন কারিগর দিয়ে সপ্তাহে তিনটা শাড়ি বানাতে পারে। আর সেখানে হাতে বুনলে এক শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১০ দিন। ফলে অল্প সময় ও খরচে অধিক শাড়ি বানানো সম্ভব বলে ভারতীয় শাড়িগুলো দাম কম এবং এসব শাড়ির বড় মার্কেটই ধরা হয় বাংলাদেশকে।’

মিরপুরের বেনারসি পল্লীর দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন দামের দেশীয় এবং ভারতীয় শাড়ি রয়েছে। তাদের মধ্যে দামের পার্থক্য ২ থেকে ৩ হাজার। মেশিনে বোনা ভারতীয় বেনারসি শাড়িগুলো দেখতে উজ্জ্বল, ডিজাইন মসৃণ এবং দাম কম হওয়াই ক্রেতারাই এর প্রতি আগ্রহ বেশি বলে জানিয়েছে বিপণন সংশ্লিষ্টরা। তবে মেশিনে বানানোর চাইতে হাতে বানানো শাড়ির মান ভালো বলে দাবি কারিগরদের।

মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় নতুন করে কোনও বেনারসির কারিগর তৈরি হচ্ছে না জানিয়ে মিল্লাত ক্যাম্পের আরেক কারিগর মুসকান বলেন, ‘২০০৪ সালের দিকে শাড়ি প্রতি মজুরি ছিল ৭০০-৮০০ টাকা। ভালো শাড়ি পেলে মজুরি থাকতো ১২০০ টাকার মত। বানাতে সময় লাগতো ৭ দিন। এখন মজুরি কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু সংসারে খরচতো বেড়ে গেছে। আগে বাসা ভাড়া ছিল ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এখন সেই বাসা চার হাজার টাকার নিচে ভাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু মজুরিতো আর বাড়েনি, বরং কমছে। তাহলে নতুন ছেলে-পেলে কেন আসবে এই পেশায়। এই পেশায় কোনও ভবিষৎ নেই। আমাদের আশঙ্কা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে মিরপুরের এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। বেনারসি মার্কেট পুরোটা ভারতের দখলে চলে যাবে।’

ফিকে হয়ে আসছে ঢাকাই বেনারসির চাকচিক্য
বেনারসি শিল্পের বিষয়ে হানিফ সিল্কের মালিক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, বেনারসি শিল্পের বর্তমান অবস্থার জন্য শুধু ভারতীয় শাড়ির আমদানিকে দোষারোপ করলে হবে না। তারা প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে গেছে। আমরা এখনও সেই সফলতা পাইনি। এটা সত্য যে, প্রতিনিয়তই বিভিন্ন উপায়ে ভারতীয় শাড়ি আমাদের দেশে আসছে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি আমাদের কারিগরদেরও আরও পেশাগতভাবে দ্বায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ। তাদেরও অলসতা রয়েছে।'

বেনারসি শিল্পের প্রতি সরকার মনযোগী হলে এই ক্ষেত্রও গার্মেন্টস শিল্পের মত দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'তাঁত পণ্যগুলোর আমদানির উপর যদি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে এ খাত আমাদের জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। পাশাপাশি তাঁতের কাচামালগুলোও দেশে উৎপাদন করার ব্যবস্থা করতে হবে।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
ধ্রুব এষ হাসপাতালে
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
সর্বশেষ খবর
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন