X
বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২

আগামী বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট বাড়তে পারে, শঙ্কা আন্তর্জাতিক সংস্থার

গোলাম মওলা
২৫ জুন ২০২৫, ০০:০১আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০০:০১

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে আগামী বছরটি আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের সংকট এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা—সব মিলিয়ে এখন অর্থনৈতিক টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনে কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে—এমন চিত্রই উঠেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে। চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নামতে পারে এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দুই আন্তর্জাতিক সংস্থা।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নাগাদ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নামতে পারে। আইএমএফও চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছে—যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশের হিসাব থেকেও কম।

কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া উত্তরণ কঠিন

ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় সোমবার (২৩ জুন) বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৮০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় সংস্থাটি। তবে এ অর্থায়নের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া পূর্বাভাসে উঠে আসে কঠোর সতর্ক বার্তা।

আইএমএফ বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, যা পূর্বাভাসের ৬ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। সংস্থাটি উল্লেখ করে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কঠোর মুদ্রানীতি ও ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইজেল ক্লার্ক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুস্তরীয় চাপে রয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’

রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। মে মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জুন মাসেই আদায় করতে হবে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা—যা ‘প্রায় অসম্ভব’ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা। বর্তমানে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বছরের শেষ নাগাদ এটি ৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো, ফলে নতুন বিনিয়োগে ঋণ দেওয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।

সরকারি ঋণ নির্ভরতা ও সুদের চাপে বেসরকারি খাত

সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ দশমিক ০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। এতে তারল্য সংকট আরও তীব্র হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের সুযোগ সংকুচিত হবে। বাড়বে সুদের হারও, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করবে।

মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক সংকট

চলতি অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ভোক্তা পর্যায়ে চাপ অব্যাহত রাখবে। আগামী অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, হরমুজ প্রণালির সংকট এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।

বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি পরিবহন ব্যাহত হয়, তাহলে জ্বালানি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স, আমদানি-রফতানি ও শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে জটিলতা তৈরি হলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারাতে পারেন। তেল-গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে দেশের শিল্প খাতও নতুন সংকটে পড়বে।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি লক্ষ্য সাড়ে ৬ শতাংশ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও নিচের মাত্রায় নামিয়ে আনতে চায়।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গুগল পে’ সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। গভর্নর বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামাতে চায়। তবে আমরা আরও আগ্রাসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি— ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে সেটাই হবে আমাদের সফলতা।’

বিনিয়োগ-রফতানিতে ভাটা, কর্মসংস্থানে প্রভাব

দেশে ও বিদেশে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাময়িকভাবে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে, তবে এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ডলার সংকট শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করছে। এতে ঋণখেলাপির আশঙ্কা বাড়ছে।’ 

একই বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, পোশাক খাতেও ঋণপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। তিন মাসের খেলাপি সীমা নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসতে যাচ্ছি।

/এপিএইচ/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সরকারের নিজস্ব উদ্যোগেও সংস্কার হচ্ছে: অর্থ উপদেষ্টা
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
বিশ্বব্যাংকের নতুন ডিভিশন ডিরেক্টর হিসেবে ঢাকায় যোগ দিলেন জঁ পেসমে
সর্বশেষ খবর
এসএসসি পরীক্ষার ফল জানা যাবে যেভাবে
এসএসসি পরীক্ষার ফল জানা যাবে যেভাবে
ঘরে-বাইরে কোমর সমান পানি, কলার ভেলায় অন্তঃসত্ত্বাকে নেওয়া হলো হাসপাতালে
ঘরে-বাইরে কোমর সমান পানি, কলার ভেলায় অন্তঃসত্ত্বাকে নেওয়া হলো হাসপাতালে
রাজনীতিবিদরা সামনে বড় কথা বলে, কিন্তু ভেতরে নেগোসিয়েশন চলে: সারজিস
রাজনীতিবিদরা সামনে বড় কথা বলে, কিন্তু ভেতরে নেগোসিয়েশন চলে: সারজিস
রাজশাহী ও রংপুরের ১৫১ থানায় অনলাইন জিডির কার্যক্রম চালু
রাজশাহী ও রংপুরের ১৫১ থানায় অনলাইন জিডির কার্যক্রম চালু
সর্বাধিক পঠিত
বেশির ভাগ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ফিকশন পাওয়া যায়: গভর্নর
বেশির ভাগ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ফিকশন পাওয়া যায়: গভর্নর
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ সরকারি চাকরিজীবীকে ওএসডি
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ সরকারি চাকরিজীবীকে ওএসডি
বগুড়ায় ঘরে ঢুকে শ্বশুর ও গৃহবধূকে হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগ
বগুড়ায় ঘরে ঢুকে শ্বশুর ও গৃহবধূকে হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগ
কল রেকর্ড বিবিসি উদ্ধার করেনি, করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা: তাজুল
কল রেকর্ড বিবিসি উদ্ধার করেনি, করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা: তাজুল
প্রশ্ন উঠছে এটা বন্যা নাকি খেসারত
প্রশ্ন উঠছে এটা বন্যা নাকি খেসারত