হিমায়িত মাংস আমদানির পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ব্যতীত তা বাজারজাত করা যাবে না। ‘হিমায়িত মাংস আমদানি, সংরক্ষণ ও বিতরণ সংক্রান্ত নীতিমালা ২০২৩’ এর খসড়ায় এ বিধান রাখা হচ্ছে। এরইমধ্যে নীতিমালার খসড় তৈরি করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরের সদস্য আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে এখন হিমায়িত মাংস বা মাছ আমদানি করা যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে একটি প্রতিষ্ঠানের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হিমায়িত মাংস আমদানি, সংরক্ষণ ও বিতরণ সংক্রান্ত নীতিমালা করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।
নীতিমালার খসড়ায় বলা হচ্ছে— আমদানিকৃত মাংসের পরীক্ষিত নমুনার সন্তোষজনক রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দ্রুততম সময়ে ছাড়পত্র দেবে। ছাড়পত্রপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেই মাংস বাজারজাত করবে এবং ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত বাজারজাত বা বিক্রি বন্ধ রাখবে।
পালন করতে হবে অত্যাবশ্যকীয় আট শর্ত
খসড়া নীতিমালায় ৮টি শর্ত পালনের বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বিদ্যমান আমদানি সংক্রান্ত আইন, বিধি ও প্রবিধানগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
আমদানিকারক, পরিবেশক, বিক্রেতাকে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য (খাদ্য ব্যবসায়ীর বাধ্যবাধকতা) প্রবিধানমালা এবং নিরাপদ খাদ্য (মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং) প্রবিধানমালাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রবিধানমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
সব আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে তার আওতাধীন সব ডিস্ট্রিবিউটর বা পাইকারি বিক্রেতার নাম, ঠিকানা, লাইসেন্স নম্বর, ফোন নম্বর ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্য বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সব আমদানিকারককে হিমাগারে মাংস সংরক্ষণ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হিমাগারের ঠিকানাসহ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের স্থানীয় কার্যালয়, অথবা প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ই-মেইলে অবহিত করার ক্ষেত্রে অটোরেসপন্স কার্যকর হবে এবং অবহিত করার ১২ ঘণ্টা পর ওই মাংস বিক্রি শুরু করা যাবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা নিয়মিত হিমাগার পরিদর্শন করবেন এবং পরিদর্শন বা পরিবীক্ষণকালে আমদানি করা মাংসের লট বা লটের কোনও অংশ অনিরাপদ মনে হলে— প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠাবে। নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেবে।
পরীক্ষিত নমুনার সন্তোষজনক রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দ্রুততম সময়ে ছাড়পত্র দেবে। ছাড়পত্রপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেই মাংস বাজারজাত করবে এবং ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত বাজারজাত বা বিক্রি বন্ধ রাখবে।
পরীক্ষিত কোনও নমুনার ফলাফলে যদি খাদ্যবাহিত বা জেনেটিক রোগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, বা ওই মাংস খাওয়ার অনুপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে ওই আমদানি করা মাংসের লট বা লটের অংশ ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০’ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থায় ধ্বংস করবে। ধ্বংস করার আগে নমুনা পরীক্ষা বা বিশ্লেষণের ফলাফলে কোনও ব্যক্তি বা পক্ষ সংক্ষুদ্ধ হলে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিষয়টি অবহিত করার তিন কর্মদিবসের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবেচনার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবে এবং কর্তৃপক্ষ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কোনও কর্মচারী পরিবীক্ষণকালে হিমায়িত মাংস আমদানি, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট যেকোনও ডকুমেন্টস দেখতে চাইলে, তা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য (খাদ্য ব্যবসায়ীর বাধ্যবাধকতা) প্রবিধানমালা অনুযায়ী, তাৎক্ষণিকভাবে প্রদর্শন বা সরবরাহ করতে হবে।
আমদানির ক্ষেত্রে
খসড়া নীতিমালায় আমদানি পর্যায়ে চারটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে— হিমায়িত মাংস আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রফতানিকারক দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত স্বাস্থ্যসনদ নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রাণিটি জবাইয়ের সময় সম্পূর্ণ রোগমুক্ত ছিল (ক্ষুরা রোগ, অ্যানথ্রাক্সসহ যেকোনও ধরনের ছোঁয়াচে রোগ), প্রাণিটির শরীরে কোনও অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ বা ক্ষতিকর ভারী ধাতুর (মাত্রা অতিরিক্ত ) উপস্থিতি ছিল না এবং প্রাণীটি জবাইয়ের পূর্ব থেকে প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা মানদণ্ড নিশ্চিতকরণের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হবে ।
হিমায়িত মাংস আমদানির সময় মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে ফুড গ্রেড মোড়ক ব্যবহার করতে হবে এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য (মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং) প্রবিধানমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
বন্দর থেকে মাংসের চালান খালাসের সময় কমপক্ষে ৫০ ভাগ মেয়াদ উত্তীর্ণের সময়কাল অবশিষ্ট থাকতে হবে।
হিমায়িত মাংস আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রফতানিকারক দেশের যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত মুসলিম রীতি অনুযায়ী, প্রাণী জবাইয়ের (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) হালাল সনদ নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবহনের ক্ষেত্রে
পরিবহন পর্যায়ে খসড়া তিনটি শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে এগুলো হলো— বন্দর থেকে মাংস অবমুক্তির পর হতে বিতরণের আগ পর্যন্ত পরিবহনের সব ক্ষেত্রে কমপক্ষে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অথবা এর নিম্ন তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবহনের সব ক্ষেত্রে কন্টেইনারে তাপমাত্রা ডাটালগার (টিডিএল) বা তাপমাত্রা পরিমাপকযন্ত্র থাকতে হবে। পরিবহনের ক্ষেত্রে অনুজৈবিকসহ কোনও ধরনের দূষণ যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংরক্ষণের ক্ষেত্রে
আমদানিকৃত মাংস সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অথবা তাপমাত্রা এর নিচে নিশ্চিত করতে হবে।
সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত কোল্ড স্টোরেজের কৃষি বিপণন অধিদফতরের অনুমোদন থাকতে হবে।
কোল্ড স্টোরেজে অবশ্যই তাপমাত্রা ডাটালগার (টিডিএল) থাকতে হবে।
কোল্ড স্টোরেজে হিমায়িত মাংস সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সব তথ্যের রেকর্ড রাখতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে সফটওয়্যার-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সুবিধার দিকে অগ্রসর হতে হবে।
কোল্ড স্টোরেজ অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ থাকতে হবে।
কোল্ড স্টোরেজে হিমায়িত মাংস ও অন্যান্য কৃষিজপণ্য অবশ্যই আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
বাজারজাত করার ক্ষেত্রে
বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আরও ৫টি বিষয় অবশ্যই মেনে চলতে হবে। এগুলো হচ্ছে— বাজারজাত করার সব পর্যায়ে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও মাংসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য (স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ) প্রবিধানমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
মাংস বিক্রির সময় মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে ফুড গ্রেড মোড়ক ব্যবহার করতে হবে। মোড়কের গায়ে অবশ্যই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও মূল মোড়কের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখসহ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নিরাপদ খাদ্য (মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং) প্রবিধানমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান/কোল্ড স্টোরেজ বা ডিস্ট্রিবিউটর বা পাইকারি মাংস বিক্রেতা কর্তৃক হিমায়িত মাংস বিক্রির সময় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হিমায়িত মাংস ক্রয়কারী সব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, লাইসেন্স নম্বর, ফোন নম্বর ইত্যাদি) বিস্তারিত তথ্যসহ ভাউচার সংরক্ষণ করতে হবে এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করতে হবে।
হিমায়িত মাংস বাজারজাত করার সময় কোনও ধরনের রঙ এবং প্রিজারভেটিভস মেশানো করা যাবে না।
খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আমদানি করা হিমায়িত মাংস বিক্রির সময় অবশ্যই আলাদাভাবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রাণীর নাম সংবলিত ঘোষণা জনসম্মুখে প্রদর্শন করতে হবে।
আরও পড়ুন:
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে