X
বুধবার, ২১ মে ২০২৫
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্রে রেমিট্যান্সে করের প্রস্তাব: কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে?

গোলাম মওলা
২০ মে ২০২৫, ২৩:৫৯আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ২৩:৫৯

রফতানির পর প্রবাসী আয়ই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বড় উৎস। অথচ এই আয় নিয়ে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের  নেতিবাচক প্রভাব শুরু হতে না হতে এবার রেমিট্যান্সেও চাপে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুমোদিত নতুন বিল ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্টের’ আওতায় অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের হাউজ বাজেট কমিটিতে ইতোমধ্যে বিলটি অনুমোদন পেয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে—যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহে বড় ধাক্কা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

নতুন কর কাঠামোর আওতায় আসবে বাংলাদেশিরাও

এই আইনে মার্কিন নাগরিক ব্যতীত সব অভিবাসীর পাঠানো অর্থের ওপরে করারোপ করা হবে। করের জন্য কোনও ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করা হয়নি, অর্থাৎ যেকোনও অঙ্কের রেমিট্যান্সেই কর প্রযোজ্য হবে। ফলে গ্রিন কার্ডধারী ও এইচ-১বি ভিসাপ্রাপ্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থের ওপর এই করও আরোপিত হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী আয়ে ৫ শতাংশ করারোপের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য ডলার সংকট মোকাবিলায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সরকারের পাশাপাশি রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতিগুলোকে এখনই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে—কীভাবে বিকল্প বাজার তৈরি ও বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোতে উৎসাহ দেওয়া যায়।

ব্যাংকিং মাধ্যমে রেমিট্যান্স কমার শঙ্কা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের বদলে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক পন্থায় অর্থ পাঠানোর দিকে ঝুঁকতে পারেন। এতে শুধু রেমিট্যান্স প্রবাহই নয়, বৈধ চ্যানেলের লেনদেনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ। সে বছর বাংলাদেশে এসেছিল ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স, যার মধ্যে বড় একটি অংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৪২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার—বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫২ হাজার ২৬ কোটি টাকা (১ ডলার= ১২২ টাকা ধরে)। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ১০৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

৫ শতাংশ কর কার্যকর হলে কেবল এই সময়ের হিসাবেই রেমিট্যান্স থেকে ২১ দশমিক ৮৫ কোটি ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যাবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রবাসী আয় হলো দায়বিহীন বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। এই অর্থ দেশের রিজার্ভ বাড়ায়, কিন্তু এর বিপরীতে কোনও বৈদেশিক দায় তৈরি হয় না। রফতানি বা বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যে ডলার অর্জন করা হয়, তার বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি কিংবা ঋণ পরিশোধ করতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল) মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ১৮ শতাংশের মতো রেমিট্যান্স সরবরাহ করেছে।

নীতিনির্ধারকদের জন্য বার্তা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বেড়ে যাবে, যা তাদের বিকল্প, অপ্রাতিষ্ঠানিক (হুন্ডি) চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় এখনই বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। একইসঙ্গে ডলার রেটের ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক পদ্ধতি ও ব্যাংকিং চ্যানেলকেই আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স হলো দায়বিহীন বৈদেশিক মুদ্রা। এই আয় দেশের রিজার্ভ বাড়ায়, কিন্তু এর বিপরীতে কোনও বৈদেশিক দায় তৈরি হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘৫ শতাংশ কর আরোপ হুন্ডি তৎপরতা বাড়াতে পারে। তাই প্রণোদনা বন্ধ করে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারের তুলনায় আকর্ষণীয় করতে হবে।’

বাজারভিত্তিক রেটই হতে পারে সমাধান

ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখার প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। এখন কিছুটা বাজারভিত্তিক রেট চালু হয়েছে। তবে এখনও তা সম্পূর্ণ নয়।’ তার মতে, ‘যদি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সে ডলারের দাম আরও বাড়ানো যায়, তাহলে প্রস্তাবিত কর সত্ত্বেও রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে না।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা রেমিট্যান্স পাঠান, তারা তুলনামূলক উচ্চ আয়ের এবং স্থিতিশীল চাকরিতে যুক্ত। তাই মধ্যপ্রাচ্যের মতো নেতিবাচক প্রভাব এখানে তুলনামূলক কম পড়বে। তবে কিছু কম আয়ের প্রবাসীর ক্ষেত্রে প্রভাব আসতে পারে।’

জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাসে প্রায় ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এর ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপ হলে প্রতি মাসেই ১৫-২০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যাবে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক বার্তা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিন অ্যাগ্রিগেটরদের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসে, তার প্রকৃত উৎস যাচাই করা জরুরি। অনেক সময় অন্য দেশ থেকে অর্থ এলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে ধরা হচ্ছে।’

প্রভাব ফেলবে বিশ্বজুড়ে

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই প্রস্তাব শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী সব নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে রেমিট্যান্স যায় সবচেয়ে বেশি, এরপর আসে মেক্সিকো, ফিলিপাইন, চীন, মিসর ও বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ, যেখানে ২৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে, যার একটি বড় অংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

এ আগে গত ২ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পাল্টা শুল্ক) ঘোষণা দেন, যা বাংলাদেশসহ একাধিক উন্নয়নশীল দেশের ওপর প্রযোজ্য হয়। এর প্রতিবাদে চীন ও ইউরোপসহ অনেক দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে, ট্রাম্প ৯ এপ্রিল ঘোষণা দেন—চীন ছাড়া বাকি দেশের জন্য নতুন শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকবে এবং এ সময়ে পারস্পরিক শুল্কহার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। যদিও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৫ শতাংশ।

এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পেলে তা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও আমদানি ব্যয়ের জন্য ডলারের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
যুদ্ধবিরতির নামে সময়ক্ষেপণ করছে রাশিয়া: জেলেনস্কি
হার্ভার্ডের আরও ৬০ মিলিয়ন ডলার অনুদান বাতিল করলো ট্রাম্প প্রশাসন
তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি আলোচনায় রাজি রাশিয়া-ইউক্রেন: ট্রাম্প
সর্বশেষ খবর
অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জিরো টলারেন্স
অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জিরো টলারেন্স
কে হচ্ছেন নতুন পররাষ্ট্র সচিব 
কে হচ্ছেন নতুন পররাষ্ট্র সচিব 
মাদকসহ আটক যুবদল নেতাকে ছেড়ে প্রতিবন্ধীকে কারাগারে পাঠালো ডিবি পুলিশ
মাদকসহ আটক যুবদল নেতাকে ছেড়ে প্রতিবন্ধীকে কারাগারে পাঠালো ডিবি পুলিশ
নিয়মরক্ষার ম্যাচে হারলো চেন্নাই সুপার কিংস
নিয়মরক্ষার ম্যাচে হারলো চেন্নাই সুপার কিংস
সর্বাধিক পঠিত
মহার্ঘ ভাতা পেতে যাচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা: অর্থ উপদেষ্টা
মহার্ঘ ভাতা পেতে যাচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা: অর্থ উপদেষ্টা
ভ্যানচালকের কাছে এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র
ভ্যানচালকের কাছে এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র
ধানমন্ডিতে মধ্যরাতে বাসার সামনে অবস্থান, আটক ৩
ধানমন্ডিতে মধ্যরাতে বাসার সামনে অবস্থান, আটক ৩
স্টারলিংকের সংযোগ কীভাবে পাবেন, কোথায় ব্যবহার করতে পারবেন
স্টারলিংকের সংযোগ কীভাবে পাবেন, কোথায় ব্যবহার করতে পারবেন
ক্যানসার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধক আলুর তিনটি জাত উদ্ভাবন
ক্যানসার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধক আলুর তিনটি জাত উদ্ভাবন