২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’ দেশের অর্থনীতিকে স্থবিরতা থেকে গতি ফিরিয়ে আনতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রায় এক বছর সময় পেরিয়ে এসেছে, আর এ সময়ে অর্থনীতির নানা সূচকে ধরা দিয়েছে ইতিবাচক অগ্রগতি। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা এ অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, গত দশকে যেসব সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছিল, যেমন- রিজার্ভ সংকট, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, রাজস্ব ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি—তা সামলানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বড় পুনরুদ্ধার, রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড, রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি—এসবের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির ভিত কিছুটা হলেও মজবুত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মূল্যস্ফীতি গত প্রায় তিন বছরের মধ্যে সব চেয়ে নিচে নেমেছে। তবে বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে এখনও উদ্বেগ কাটেনি।
রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে দৃশ্যমান সাফল্য
২০২৪ সালের জুনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। তবে জুলাই আন্দোলনের পর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—রেমিট্যান্স প্রণোদনা হার ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করা এবং হুন্ডি প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর অভিযান। এই পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড গড়ে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে। এই অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল রেমিট্যান্স। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার, যা এক অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গত ১০ মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না। কড়াকড়ি শিথিল করায় আমদানিকারকরা এখন ব্যাংক থেকেই সহজে ডলার পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নিয়োগের পর রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও নিয়মিত তথ্য প্রকাশের সংস্কৃতি শুরু হয়, যা বাজারের আস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণ ছাড়ের কারণে রিজার্ভে স্থিতি ফিরে এসেছে।
তবে এই স্বস্তির পরিস্থিতি কতদিন থাকবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে এখন একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। পুরনো খেলোয়াড়রা চলে গেছে, নতুনরাও এখনও শক্তভাবে গেড়ে বসেনি। কিন্তু তারা যদি আবার সক্রিয় হয়, দুর্নীতির সেই পুরনো খেলা ফিরে এলে আবারও সংকট ফিরে আসবে।”
ডলারের দাম কমছে, বৈদেশিক চাপ হ্রাস
বিশ্ববাজারে ডলারের দাম কমে আসা এবং দেশীয় রিজার্ভ বাড়ায় মুদ্রাবাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এলসি নিষ্পত্তি হচ্ছে ১২৩-১২৪ টাকা হারে, আর ব্যাংকগুলো এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনছে ১২২.৭০ টাকায়। আমদানি খাতে চাপ কম থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে।
রফতানিতে চাঙা পোশাক খাত, প্রবৃদ্ধি ৮.৫৮ শতাংশ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বড় অবদান এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে—৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাত থেকে আয় ২১.১৬ বিলিয়ন এবং ওভেন পোশাক থেকে ১৮.১৮ বিলিয়ন ডলার।
প্লাস্টিক, চামড়া, চামড়াবহির্ভূত জুতা, বাইসাইকেল ও মানবচুলের রফতানিতেও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে সদ্য বিদায়ী জুন মাসে রফতানি আয়ে ৭.৫৫ শতাংশ হ্রাস পাওয়ায় কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীলতা
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে গিয়ে ব্যবসায় ও জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। সরকার দ্রুত আমদানি শুল্কে ছাড়, ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, টানা চার মাস ধরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমছে। গত জুন মাসে তা নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা গত প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি নেমেছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে। এরপর এতটা নিম্ন হার আর দেখা যায়নি।
সোমবার (৭ জুলাই) বিকালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ চিত্র প্রকাশ করে। এতে জানানো হয়, চলতি বছরের জুন মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে, যা বিগত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
সরকার আমদানি শুল্কে ছাড়, টিসিবি কার্যক্রম জোরদার এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরপর এপ্রিলে কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে, মে মাসে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং সর্বশেষ জুনে তা আরও কমে হয় ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত আয় কমে যায়। অনেককেই ধারদেনায় পড়তে হয় বা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাতে হয়। অর্থনীতিবিদরা একে এক ধরনের ‘গোপন কর’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের সুচিন্তিত নীতি ও কৌশলের ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে যেটি ছিল ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ, জুন ২০২৫-এ তা ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যবহির্ভূত খাতেও কমতির ধারা শুরু হয়েছে। আশা করছি আগামী মাসগুলোতে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি, খাদ্য ও আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ মুদ্রানীতি ও নীতিগত হস্তক্ষেপের সুফল ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে হলে উৎপাদন বাড়ানো ও বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষতা আনতে হবে বলে তারা মনে করেন।
তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে এনবিআরের সেবা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর ব্যবস্থাকে সহজ, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়িয়েছে। করদাতারা এখন ঘরে বসেই আয়কর রিটার্ন দাখিল, ভ্যাট পরিশোধ ও কাস্টমস সংক্রান্ত কাজ করতে পারছেন অনলাইনে।
সম্প্রতি চালু হওয়া ‘a‑Chalan’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টাই রাজস্ব পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে, যা আমদানি-রফতানির গতিকে দ্রুততর করেছে। এ ছাড়া ই-রিটার্ন, ভ্যাট অনলাইন সিস্টেম (VOSS) এবং ASYCUDA World সফটওয়্যার ব্যবহারে কাস্টমস-সেবা আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে।
এনবিআরের নিজস্ব ড্যাশবোর্ড ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের কার্যক্রম মনিটর করা সম্ভব হচ্ছে, যা জবাবদিহি বাড়িয়েছে।
তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক করদাতা এখনও ডিজিটাল সেবায় অভ্যস্ত নন। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি আছে। এছাড়া ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করে এনবিআরকে দুটি ইউনিটে ভাগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কর অব্যাহতি ও ভর্তুকির তালিকা হালনাগাদ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়ে ‘ট্যাক্স গ্যাপ’ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংক খাতে সংস্কার
জুলাই আন্দোলনের পর নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে ব্যাংক খাতে পাঁচটি বড় সংস্কার চালু হয়েছে—
১. দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ: সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ ও বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনার পরিকল্পনা।
২. অর্থপাচার ও লোপাট তদন্ত: ১৭ বিলিয়ন ডলার লোপাটের তদন্তে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
৩. একক বিনিময় হার চালু: বিভিন্ন উৎসে ভিন্ন রেট বাতিল করে একক রেট চালু করে বাজার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
৪. শাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ব্যাংকের মালিকানা, পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণ অনুমোদনে স্বচ্ছতা বাড়ানো। ‘ইনসাইডার লোন’ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নজরদারি।
৫. আইনি কাঠামো সংস্কার: সাংবিধানিক মর্যাদা ও গভর্নরের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে খসড়া আইন প্রণয়ন।
এছাড়া এরইমধ্যে কিছু ব্যাংকে পরীক্ষামূলকভাবে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি চালু করা হয়েছে এবং তা ইতিবাচক ফল দিয়েছে। তাই চলতি জুলাই থেকে ধাপে ধাপে সব তফসিলি ব্যাংকে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন শুরু হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, এই নতুন তদারকি কাঠামোর আওতায় প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক, বাজার, পরিচালনাগত, আইনগত এবং কৌশলগত ঝুঁকি আরও সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। সেই ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও দ্রুত নেওয়া যাবে। এতে প্রতিটি ব্যাংকের কার্যক্রম আলাদাভাবে মূল্যায়ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোয় দ্রুত হস্তক্ষেপ করা সহজ হবে।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে
তবে এখনও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ৯.৮ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। চলতি বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.৯৫ শতাংশে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯.৮ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক কম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতের সংকট ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
ঋণখেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা এবং মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে গতি থমকে রয়েছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বেসরকারি খাতে ঋণ তখনই বাড়বে, যখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরবে। অনিশ্চিত পরিবেশে কেউ বিনিয়োগে যায় না।” তিনি আরও বলেন, “একদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও খুব একটা উন্নতি হয়নি। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে বেসরকারি ঋণের ওপর।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ঋণখেলাপি বাড়ছে, নতুন ঋণ বিতরণ কমছে এবং অনেক ব্যাংকের পুঁজি ঘাটতি রয়েছে—এসব কাঠামোগত সমস্যার কারণে ব্যাংকিং খাত এখন চরম চ্যালেঞ্জে। চলতি বছরের মার্চের শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারও এখন ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হলে আমদানি, বিশেষ করে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি বাড়াতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সামগ্রিকভাবে আমদানি এলসি খোলা ২.৯৮ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি ৬.০৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি যথাক্রমে ২৭.৪৬ শতাংশ ও ২৫.৫৬ শতাংশ কমেছে, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়।
সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। এর সঙ্গে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ায় ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে পড়েছে। ফলে ব্যবসায় ঋণ পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠছে।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতায় বহু শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বেশিরভাগ কারখানাই তাদের পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে পারছে না। চাহিদার ঘাটতিতে বাড়ছে ঋণখেলাপির ঝুঁকি।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে নতুন ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “উচ্চ উৎপাদন ব্যয় এবং ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি থমকে যাচ্ছে।”
তবে আশার কথা, নতুন বাজেট কার্যকর হওয়ায় এবং সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ব্যাংকাররা মনে করছেন, আগামী মাসগুলোতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়তে পারে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা বেসরকারি খাতে আস্থার কিছুটা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার নতুন দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করেছে এবং উদ্যোক্তা সহায়তার জন্য ব্যাংক ও বিডার সমন্বয়ে ‘ইনভেস্টমেন্ট উইন্ডো’ চালু করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ প্রণোদনা প্যাকেজের পুনর্মূল্যায়ন চলছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশা মতো বাড়ছে না।