‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ বাতিলের দাবি থেকে সরে এসেছে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এখন আর আইনটি বাতিলের দাবি করছেন না তারা। সরকার নতুন করে আইনটিতে যে সংশোধনী এনেছে তাতেই খুশি। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কোনও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা না করার কথাও ভাবছেন তারা। তবে চলমান আন্দোলনের সমাপ্তিও টানছেন না। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদন পাওয়া ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর সংশোধনীসহ অধ্যাদেশ জারির পর তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ সংশোধন করে অসদাচরণের জন্য সরকারি কর্মচারীদের কোনও কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্তের বিধান বাদ দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর পরিবর্তে পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে যে কাউকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান করা হচ্ছে।
সূত্রের তথ্যমতে, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই সংশোধন করা হচ্ছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে এ-সংক্রান্ত সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া গত ৩ জুলাই চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এরপর তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অধ্যাদেশ সংশোধনসহ প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
সূত্র জানায়, অধ্যাদেশটিতে সংশোধন করে অনানুগত্য এবং কোনও কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে বা কাজ না করার জন্য উসকানি ও প্ররোচিত করার ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরু থেকেই আইনটিতে কোনও সংশোধনী নয়, পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছিল সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এই দাবিতে সংযুক্ত পরিষদের উভয় অংশ এক হয়ে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে মিছিল, বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতি এবং উপদেষ্টাদের কাছে দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশসহ নানাবিধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
সচিবালয়ে আন্দোলনরত কর্মচারীরা বলে আসছিলেন, বহুল আলোচিত সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি হলে বিভাগীয় মামলার পরিবর্তে শুধু একটি লেটার দিয়ে সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা দণ্ড দেওয়া যাবে, কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তার কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসে পরিণত হবেন, ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে, বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবেন, চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে, অপছন্দ হলে কর্মকর্তার রোষানলে পড়বেন, একজন অভিযোগকারী কর্মকর্তা নিজেই তদন্তকারী ও বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, ভয়ভীতির কারণে সরকারি কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তাই ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিল করতে হবে- এই দাবিতে চলা আন্দোলন স্থগিত রেখে ১০ দিনের জন্য ঈদের ছুটিতে যান সরকারি কর্মচারীরা। ছুটি শেষে দাবি আদায়ে আবার শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনে কারণে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে কর্মপরিবেশ, শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখাসহ নাগরিকসেবা দেওয়া অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।
উল্লেখ্য, ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে গত ২৪ মে থেকে আন্দোলন করেছেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। দাবি না মানলে দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাবেন বলে জানান তারা। চার ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে- এমন বিধান রেখে গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন হয়। এরপর ২৫ মে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
সরকারের জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন বলে অধ্যাদেশে উল্লেখ ছিল।
অধ্যাদেশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম একটি লিখিত বক্তব্য দেয়। ফোরামের মতে, নারী সহকর্মীদের ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশে কাজ করতে হবে, কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেও চাকরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, এমনকি কেউ কেউ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কারণেও কর্মকর্তার রোষানলে পড়তে পারেন, দেশ ও জাতির সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে, কর্মচারীদের ন্যায্যতা-প্রাপ্যতার দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাধা সৃষ্টি করবে, ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আমাদের দাবি না মানা হলে বড় পরিসরে আন্দোলনে যাবো। বড় ধরনের কর্মবিরতি পালন করবো এবং সেই কর্মসূচিতে সারা দেশের সব অফিসের কর্মচারীদের সম্পৃক্ত করা হবে। ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’-কে ‘কালো আইন’ বলে এটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আবারও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আন্দোলনকারী কর্মচারীরা।
ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান মুহা. নুরুল ইসলাম সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি ভেবে থাকেন আন্দোলন থেমে গেছে, তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমরা এমন কর্মসূচি দেবো, কল্পনা করতে পারবেন না। যদি এই আইন বাতিল করা না হয় শুধু কর্মবিরতি নয়, প্রয়োজনে অবস্থান কর্মসূচিও দিতে পারি। দরকার হলে সারা দেশে ডিসি অফিস, বিভাগীয়সহ সারা বাংলাদেশে এই কর্মসূচি ছড়িয়ে দেবো।’ তিনি বলেন, ১৫ জুনের মধ্যে ভালো সংবাদ না পেলে নেতারা বসে কঠোর কর্মসূচি দেবেন।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ৩ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে আন্দোলনকারী কর্মচারীরা সচিবালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ২২ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন তারা।
জানা যায়, এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে। আসিফ নজরুল আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব দিলে সরকারি কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ নেতারা কোনও সংশোধনী নয় বরং আইনটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেন। এমন পরিস্থিতিতে চলমান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। স্তিমিত হয়ে পড়ে আন্দোলন। এরই মধ্যে গত ৩ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদ আইনটিতে সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে।
এ বিষয় জানতে চাইলে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ একাংশের মহাসচিব নিজাম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেই আইনটিতে সংশোধনী এনেছে। এতে আমরা খুশি। তাই এই ইস্যুতে নতুন করে আর কোনও আন্দোলন কর্মসূচি দিতে চাই না। অধ্যাদেশ জারির পর এ বিষয়ে আমরা আন্দোলন করা না করার চূড়ান্ত ঘোষণা দেবো। তবে চাকরি আইনের বাইরে আমাদের ঘোষিত ৯ দফা আন্দোলন স্বাভাবিক নিয়মেই চলবে।’