X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে রোহিঙ্গাদের ঢল

আবদুর রহমান, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে
১৭ মে ২০১৯, ১২:০২আপডেট : ১৭ মে ২০১৯, ১২:১১

পাচার হওয়ার সময় আটক রোহিঙ্গারা উন্নত জীবনের আশায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।  গত সপ্তাহে তিন দিনে  দেড় শতাধিক মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাকে আটক করেছে কক্সবাজার পুলিশ। জেলার  টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। তাদের  বেশির ভাগই নারী ও শিশু।  পুলিশ  জানিয়েছে,  আটক এই রোহিঙ্গাদের কেউ চাকরি, কেউ উন্নত জীবনের আশায়, আবার কেউ কেউ বিয়ের প্রলোভনে পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

গত সোমবার (১৩ মে) রাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে দুজন রোহিঙ্গা। পুলিশের দাবি,নিহত দুই রোহিঙ্গা মানবপাচারকারী ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র  বলছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানবপাচারকারী চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করলে প্রাণের ভয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গা। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে  ৩৪টি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে।  রোহিঙ্গাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।  একারণে গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে সাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে মালয়েশিয়ায় পাচারের চেষ্টা বেড়েছে।  

কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান,  গত  রবি, সোম ও মঙ্গলবার (১২, ১৩ ও ১৪ মে)  তিন দিনেই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে দেড় শতাধিকের মতো রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে রোহিঙ্গা পাচার বেড়ে যাওয়ায় আমরাও একটু চিন্তিত। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা মানবপাচার চক্রের প্রলোভনের শিকার হয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কক্সবাজার উপকূল এলাকায় হওয়ায় শুধুমাত্র পুলিশের পক্ষে  মানবপাচার রোধ করা সম্ভব না। তাই চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশিং কমিউনিটির সদস্যরা মানবপাচার ঠেকাতে মাঠে কাজ শুরু করেছেন।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘মানবপাচারকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। সমুদ্রপথে পাচার রোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আটক রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।’  পাচার হওয়ার সময় আটক রোহিঙ্গারা

চার মাসে ৪৪০ রোহিঙ্গা আটক
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে মতে,  গত চার মাসে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাত্রাকালে ৪৪০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এর মধ্যে পুলিশ ৪০০ এবং বিজিবি ৪০ জনকে আটক করে।  তারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।
পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (১৪ মে)  রাতে টেকনাফের নোয়াখালীপাড়া এলাকা থেকে ৩১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়, এদের চার জন শিশু,২০ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ। একই দিন রাতে কক্সবাজারের কলাতলীর শুকনাছড়ি ও দরিয়ানগর সমুদ্র ঘাটে জড়ো হয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার সময় ২৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে। এদের মধ্যে ১৩ জন নারী, ৬ শিশু ও ৯ জন পুরুষ। এসময় পাচারের কাজে জড়িত একটি নৌকাও জব্দ করা হয়।
গত সোমবার (১৩ মে) টেকনাফে আটক করা হয় ১৯ জনকে।  মধ্যে ৫ জন শিশু, ১২ জন নারী ও ২ জন পুরুষ। এরা সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য উপকূলের বাহারছড়ায় অবস্থান করছিল। একই দিন কক্সবাজারের মহেশখালীর পাহাড়ি এলাকা থেকে মালয়েশিয়াগামী আরও ২৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। 
গত রবিবার (১২ মে) ওই এলাকা থেকেই আরও ১২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ, তাদের মধ্যে ৮ জন শিশু ও ৪ জন নারী রয়েছে। এছাড়া, ১৩ মে উখিয়ায় ইনানী উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তাদের ১৭ জন নারী, ৪ জন শিশু ও ২ জন পুরুষ। তারা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালাচ্ছিলেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কার হয়।  মিয়ানমার,বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সমুদ্রপথে পাচারের শিকার হয়ে বন্দিশিবিরে, কিংবা যাত্রাপথে প্রাণ হারানো মানুষদের এসব কবর সে সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই বছরই প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করছিল বলে এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

উন্নত জীবনের আশা, নাকি প্রলোভন
টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবুল কালাম (৩০) এর মতে, মালয়েশিয়ায় আত্মীয়-স্বজন রয়েছে এমন রোহিঙ্গারা উন্নত জীবনের আশায় শিবির থেকে বের হয়ে সমুদ্রপথে  ওই দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গা দালালের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু দালাল জড়িত রয়েছে।
তবে একাধিক শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার লক্ষ্যে শিবির থেকে অনেক রোহিঙ্গা বের হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও অনেকের কোনও খোজঁ-খবর নেই।  তারা সবাই গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না এই নেতারা। 
উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন,  ‘এই বিশাল রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত কর্মহীন রোহিঙ্গাদের বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে মানবপাচারকারীরা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে উৎসাহিত করছে। এছাড়া, তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে এমন ভয়ও দেখানো হয়। ফলে রোহিঙ্গারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাচ্ছে।’

উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামীদের বরাত দিয়ে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, ‘রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করা হচ্ছিল। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।  একদিন আগে তাদের একত্রিত করে দালালরা। সোমবার রাতে সমুদ্রে একটি ট্রলারে এই রোহিঙ্গাদের তুলে দেওয়ার কথা ছিল। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর মাথাপিছু দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়ার চুক্তি ছিল দালালদের সঙ্গে।’

বন্দুকযুদ্ধে দুই রোহিঙ্গা ‘মানবপাচারকারী’ নিহত
গত সোমবার (১৩ মে) রাতে পুলিশের সঙ্গে মানবপাচারকারীদের গোলাগুলির ঘটনায় দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি বলেন, ‘টেকনাফের শাপলাপুর মেরিন ড্রাইভ উপকূলে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের জড়ো করে সমুদ্রপথে ট্রলারে উঠিয়ে দেওয়ার খবরে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাচারকারীরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এ ঘটনায় দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় এবং  চার পুলিশ সদস্য আহত হন।’
নিহত রোহিঙ্গারা হলেন, টেকনাফের বাহারছড়া শাপলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আব্দুর রহিমের ছেলে আজিম উল্লাহ (২৫) ও জামতলী ক্যাম্পের মৃত রহিম আলীর ছেলে আব্দুস সালাম (৫২)।

ওসি বলেন, ‘যেসব মানবপাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যেকোনও মূল্যে সমুদ্রপথে মানবপাচার বন্ধ করা হবে।’

জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, ‘হঠাৎ করে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের ঘিরে ফের তৎপর মানবপাচারকারীরা


/এফএস/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
চীন সফর নিয়ে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনরোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের অধিকতর কার্যকর ভূমিকা চেয়েছে বিএনপি
বৈশ্বিক অনুদান কমায় রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে
বিপুল পরিমাণ মাদকসহ রোহিঙ্গা তরুণ আটক
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৫)
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
হাসপাতালের বারান্দায় দুই প্রসূতির সন্তান প্রসব, এক নবজাতকের মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!