X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ম যার যার মূর্খতা সবার

শেগুফতা শারমিন
১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:২৫আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৩৫

শেগুফতা শারমিন ঋতু হিসেবে শরৎ খুব সুন্দর। গরম এবং শীত দুইটার মাঝখানে বাফার ঋতু হিসেবে কাজ করে। তীব্র গরমের পর হালকা একটা শিরশিরে ভাব। গ্রামে এসময় খেয়াল করলে দেখা যায় শিশির পড়ে। এর সাথে টুপটুপ করে পড়ে শিউলী ফুল। বর্ষায় ভরে ওঠা ডোবায় ফোটে শাপলা। বৃষ্টিতে জমা কাঁদা ত্যাকত্যাকে জমিতে জেগে ওঠে সাদা কাশের বন। এইরকম শরতে বহু বহু বছর আগে থেকে এই ভূভারত উৎসবে মেতে উঠতে অভ্যস্ত। বলা বাহুল, সেই উৎসব ধর্ম কেন্দ্রীক। এক সময় এদেশে ধর্মই ছিল সংস্কৃতি, সংস্কৃতিই ছিল ধর্ম। সুতরাং মানুষ, ধর্ম, প্রকৃতি ছিল একে অন্যের সঙ্গে তুমুলভাবে সম্পর্কিত। সেই ভূখণ্ডে এরপর কত পালাবদল। কত শাসন, শোষক আর ধর্ম প্রচারকদের আসা যাওয়া । মশলার লোভ, খনিজের লোভ, জমির লোভ, ব্যবসায়ের লোভ কত মানুষকে টেনে এনেছে এই ভূখণ্ডে। নানারকম মানুষের সঙ্গে এসেছে নানা ধর্ম, নানা সংস্কৃতি। তাই ভূভারতে এখনও বহু ধর্মের মানুষের বাস। এক ধর্মের ভেতরে থেকেও নানা গোত্রের বাস এই ভূভারতেই। অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বাংলাদেশও এই একই ধারা বহন করে। এদেশে এখনও বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি। কোনটা মৌলিক, আজ তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
প্রশ্ন সাপেক্ষ কারণ আমরা বার বার বহুবার জেনে বুঝে প্রভাবিত হয়ে অথবা একান্তই না বুঝে না জেনে, ধীরে ধীরে সরে গিয়েছি শেকড় থেকে, মৌলিকতা থেকে। যে কোনও নতুনকেই হুট করে আঁকড়ে ধরাই যে আধুনিকতা না। সেটাও আমরা মাথায় রাখিনি। যে কারণে আমাদের নিজস্ব পোশাক, নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস সর্বোপরি নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে কোন পাতালে। এখন তাই আমরা হাতড়ে বেড়াই। যেখানে দেখি ছাই, উড়াইয়া দেখি তাই।

আমাদের নিজস্ব যেসব উৎসব ছিল এতদিন। কবে কখন সেগুলোকে সেকেলে বলে অস্বীকার করেছি। বিয়ের উৎসবে গাওয়া ‘গীত’ কে মনে হয়েছে সেকেলে। সুতরাং, আমরা আধুনিক হয়েছি হিন্দি গান আর ভাংড়া নাচে। একসময় গ্রামে উৎসব মানেই ছিল রঙ খেলা। সেই রঙ আমাদের দৃষ্টিকটু লাগতো। তাই সেখান থেকে বের হয়ে এসেছি। এখন টেলিভিশনে হলি উৎসব দেখে আমরা নতুন করে দোল পূর্ণিমায় রঙ খেলতে নামি। সঙ্গে নিজেদের প্রমাণ করি অসাম্প্রদায়িক এবং আধুনিক। এই জন্য যারা মূল দোল খেলার ধারক বাহক তাদের বিরক্ত করছি কিনা সে খেয়াল করি না। শীতকাল মানে পালা গান। রাত ভরে সারা গ্রাম একসঙ্গে বসে হুল্লোড় করার সংস্কৃতি আমরা কবে ভুলে গিয়েছি নিরাপত্তার অজুহাতে। শুধুমাত্র কৃষিকে ঘিরে আমাদের কত রকম উৎসব হতো। ফসল রোপণ, ফসল তোলা সব কিছুই ছিল উৎসব মুখর। আমাদের শহরমুখীতা, আমাদের পুঁথিগত বিদ্যা শিক্ষার দায় আমাদের ‘চাষা’ নাম ঘুচিয়েছে। সুতরাং চাষাদের সেই পার্বনও হারিয়ে গেছে। নদী ছিল আমাদের আরেক উৎসবের কেন্দ্র। আমাদের স্বল্প বিদ্যার জোরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন নদীগুলোকে মেরে ফেলেছে বহু আগে।

কৃষিবিহীন, নদীবিহীন, নামকাওয়াস্তে শিক্ষিত, শহুরে কংক্রিটের জংলি বস্তিতে নাক মুখ সিঁটকে থাকা মধ্যবিত্ত এখন উৎসবের উছিলা খুঁজি। একদিকে নতুন উছিলা খুঁজি। আরেক দিকে সেই প্রাচীন অভ্যাসের বশে এতদিনের টিকে থাকা নিজস্ব উৎসবগুলোকে নাক সিঁটকাই। চিরন্তন বাঙালি মুসলমান অনেক কিছুর মতোই এখন ধর্মীয় উৎসবগুলোতে পাশ কাটাতে চায়। প্রমাণ করতে চায় নিজে কতটা আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক। প্রতি কোরবানিতে পশুপ্রেম বেড়ে যায়। অথচ এই শরৎকাল আসলে তারাই কোরাস গায় ধর্ম যার যার উৎসব সবার। অবশ্যই ধর্ম যার যার। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আবার উৎসবও সবার। উৎসবে সবাই এক না হলে, শামিল না হলে সেটা উৎসবই না। কিন্তু ধর্ম ভিত্তিক উৎসবের রয়েছে কিছু নিজস্বতা। কিছু অবশ্য পালনীয় বিষয়। যা কোনোভাবেই সবার না।

যারা হলি উৎসব করে, তারা একান্তই তাদের ধর্ম বিশ্বাস থেকে এই উৎসব করে। তাদের রীতি-নীতি আছে। এই রীতি-নীতি বিশ্বাস থেকে তারা উৎসব উদযাপন করে। হাতে গোনা পাঁচজনের সেই উৎসবে যখন উৎসব সবার স্লোগান নিয়ে আমরা আরো পঞ্চাশজন মিলতে যাই। সেটা তাদের জন্য সবসময় স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। যেমন পঞ্চাশের নামাজের নীরবতায় পাঁচের কির্তন বাজলে অস্বস্তি তৈরি হয়। একে অন্যের ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা মানে যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে দেওয়া। ধর্মে ধর্মে যে ভিন্নতা, যে পার্থক্য সেটা অস্বীকার করে মিলে মিশে যাওয়া নয়। আর যিনি বা যারা নিজেদের মনে করেন, ধর্মের ঊর্ধ্বে যেকোনও ধর্ম ভিত্তিক উৎসবই তো তাদের কাছে হওয়া দরকার নৈবচ। তারা পারিবারিকভাবে যে ধর্মকে বহন করেন, সেটা বাদ দিয়ে, সেই ধর্মের উৎসবে শরিক না হয়ে নিজের ধর্মহীনতা প্রকাশ করেন। আর অন্য ধর্মের উৎসবে শরিক হন, উৎসব সবার বলে। তাহলে সোজা বাংলায় বলবো এটা স্ববিরোধিতা। ঈদ বলি বা পূজা বলি অথবা ক্রিসমাস বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা। সবক্ষেত্রে ধর্ম আগে তারপর উৎসব। মানে উৎসবের ভিত্তি এখানে ধর্ম।

যেটা বলছিলাম, নির্দিষ্ট রীতি নীতি। কোরবানির যেমন একটা নিয়ম আছে। ঠিক তেমনই নির্দিষ্ট নিয়ম আছে দুর্গা পূজার। কিভাবে প্রতিমা তৈরি হবে, কিভাবে স্থাপন হবে, কখন কোন মন্ত্র পড়া হবে প্রতিটা ধাপ সুনির্দিষ্ট। দুর্গা পূজা মানে দুর্গার অনুসারীদের কাছে শুধু কয়েকটা মানুষের মূর্তি নয়। দুর্গা পূজা মানে বিশ্বাস, ভরসা, পবিত্রতা। সেই দুর্গা প্রতিমাকে হুট করে বাজার থেকে কিনে আনলেন আর বসিয়ে দিলেন বাড়ির বারান্দায়। এরপর ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিলেন, আমার বাড়ির দুর্গা। মনে মনে ভাবছেন, যাক বিশাল সেক্যুলার হয়ে গেলেন! উৎসব তো সবার। সেই উৎসবে শামিল হয়ে গেলেন! কিন্তু অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলছি। এই আচরণে মোটেও সেক্যুলার হয়ে যাওয়া যায় না। বরং অন্যের ধর্মের আচরণকে অসম্মান করা হলো টেরই পাওয়া গেলো না। কারণ এখানে মূর্খতা সবার।

এই মূর্খতাই আমাদের শেকড় থেকে সরিয়ে এনেছে। এই মূর্খতাই আমাদের পরিণত করেছে উৎসববিহীন জাতিতে। এই মূর্খতা আমাদের নিজস্বতাকে হত্যা করে অনুকরণ করতে শিখিয়েছে। যে কারণে আমাদের অন্যেরটা ভালো লাগে, নিজেরটা খারাপ। আবার এই মূর্খতাই এক মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি ছুটিয়ে অন্য মুখে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে চরম সাম্প্রদায়িক মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। আজকের অবস্থান কালকে পরিবর্তন হয়ে যায়। আজকের আপাত নিরীহ স্লোগান কালকে হয়ে যায় আত্মঘাতী। আজকে বন্ধুর হাতে কালকে হাতিয়ার ওঠে যায়। আজকের সৎ কাজের পেছনের অসৎ উদ্দেশ্য কালকে প্রকাশ পায়। 

সুতরাং এই যে, উৎসব সবার বলে স্লোগান জনপ্রিয় হয়। আমার সন্দিহান মনে শঙ্কা জাগে। আমাদের এ বুমেরাং ছোঁড়ার সংস্কৃতিতে কবে না জানি রাম শ্যামদের বাধ্য করা হবে, কোরবানিতে সামিল হতে! কারণ, ওই যে, উছিলাতো না বুঝে শুনে একদল তৈরিই করে দিচ্ছে। ধর্ম ভিত্তিক উৎসব তাই যার যারই থাক। বরং সবার মূর্খতাকে কমিয়ে আনি।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ