X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিবাদ বিকাশে শিক্ষা ব্যবস্থার দায়

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০১ মার্চ ২০২১, ১৫:১৯আপডেট : ০১ মার্চ ২০২১, ১৫:১৯

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদের বিকাশ লক্ষ্যণীয়। ফলে জঙ্গিবাদকে সমূলে উৎপাটনের দাবি উঠছে সুধি মহল থেকে। কিন্তু জঙ্গিবাদের মূল শিকড় এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রোথিত রয়েছে। কারণ জঙ্গিবাদে যুক্ত অনেকেই কোনও না কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র। কোনও অশিক্ষিত ব্যক্তি এসব হত্যাকাণ্ড অথবা উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বলে বর্তমান সময়ে খুব কম শোনা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষিতরাই উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদকে লালন করছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দায় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। বাংলাদেশের সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষার কারিক্যুলামে সরাসরি জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া না হলেও ওই কারিক্যুলাম যে জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থার উত্থান ও বিকাশকে প্রতিরোধ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থী যুক্ত হওয়াই প্রমাণ করছে, উভয় ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে।

শিক্ষা মানুষকে প্রগতিশীল, মানবিক, সংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীদের উগ্রপন্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়াই প্রমাণ করছে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সেই পথে হাঁটছে না। বাংলাদেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে জঙ্গিবাদকে লালন করছে। অজপাঁড়া গায়ের একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মতো তারাও ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের হত্যাকেই ধর্ম বলে মানছে। শহরের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের চিন্তা চেতনা আর অজঁপাড়াগায়ের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনার মধ্যে পার্থক্য না থাকায়ই প্রমাণ করছে যে, এদেশের বর্তমান প্রচলিত উভয় ধারার (মাদ্রাসা ও সাধারণ) শিক্ষা প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, সংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমস্ক মানুষ গড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই জঙ্গিবাদকে সমূলে বিনাশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রথমে সংস্কার করতে হবে। শিক্ষা কারিক্যুলামে পরিবর্তন করে আরো আধুনিক, যুগোপযোগী ও প্রগতিশীল ধারার শিক্ষা চালুই এই সংকটের সমাধান হতে পারে।

মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে আলিয়া ও কওমির কারিক্যুলামে যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও শিক্ষার মূল দর্শন ও চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে উভয় শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে। উভয় শিক্ষা ব্যবস্থায়ই ইসলামের মরমী দর্শন, অসাম্প্রাতিক চেতনা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞানমস্কতা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আলিয়া মাদ্রাসায় সাধারণ শিক্ষার মতো বাংলা, ইংরেজি বা বিজ্ঞান শিক্ষা যুক্ত হলেও কওমির মতো সেখানেও ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবলমাত্র ইসলাম কায়েম করা সম্ভব’ বলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামি পৌরনীতি বইয়ে বলা হয়েছে, ‘মানব রচিত বাতিল ব্যবস্থার উৎখাতের চেষ্টার নামই হল ইসলামি আন্দোলন। এই আন্দোলন সকল নবী রাসূলের আন্দোলন।’ (ইসলামিয়া কুতুবখানা, পৃ. ৩৬১-৩৬২)।

যদিও ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে এই বক্তব্যের কোনও মিল নেই। আল-কুরআন ও আল-হাদিসের কোথাও কোনও ব্যবস্থাকে ‘উৎখাত করার’ জন্য নবী রাসূলকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বরং অন্যের মত বা ব্যবস্থা বা ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলা হয়েছে। আল-কুরআনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘দীন-ধর্ম সম্পর্কে কোনও জোর-জবরদস্তি নেই।’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)। অথবা ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদের তোমরা গালি দিও না, কেননা, তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে...।’ (সূরা আন্’আমর : ১০৮)।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলামের ওই মৌলিক শিক্ষাকে জোরালোভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে না অনেক সময়। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই বর্তমানে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ছে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি করা নতুন কোনও ঘটনা নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনদশায় ওই ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের মাদ্রাসার কারিক্যুলামে যদি ওই সম্পর্কিত পাঠ অন্তর্ভূক্ত করা হতো তবে শিক্ষার্থীরা জানতে পারত, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটুকথা বলার পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও সাহাবীরা কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের মাদ্রাসায় ওই বিষয়গুলো পড়ানো হয় না। উকবা বিন আবি মুয়াইত নামক একজন পৌত্তলিক কর্তৃক চাদর দিয়ে হযরত মুহাম্মদকে (সা.) হত্যার চেষ্টা করা হলেও হযরত আবু বকর (রা.) হত্যার চেষ্টাকারীকে হত্যা না করে বরং হযরত মুহাম্মদকে (সা.) দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করা এবং উকবাকে বিনয়ের সঙ্গে বলার (তোমরা একটা মানুষকে কি এই অপরাধে খুন করে ফেলবে যে, তিনি আল্লাহকে নিজের মালিক বলে ঘোষণা করেছেন) মতো প্রভৃতি ঘটনা পড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় না। যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা অর্থাৎ তাকে কুটুক্তি করা বা গালি দেওয়া বা হত্যার চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের আচরণ শিক্ষা দেওয়া হতো; তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পথ রুদ্ধ হত। জঙ্গিরা যদি জানত হযরত মুহাম্মদ (সা.) তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ ও তাকে নিয়ে কটু কথা বলার অপরাধে কাউকে হত্যা করেননি। বরং তিনি ওই ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে উদারতা ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, তাহলে শত প্রলোভন দিয়েও অনেককে জঙ্গিবাদে যুক্ত করা যেত না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা পড়ানো হচ্ছে তা জঙ্গিবাদ নির্মূলের ক্ষেত্র ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর ওই সুযোগই উগ্রপন্থীরা গ্রহণ করে ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যকে চারিতার্থ করছে। শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীদের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে উগ্রপন্থায় যুক্ত করছে। কিন্তু যদি শিক্ষার্থীরা ধর্মের প্রকৃত মর্ম জানত; তবে উগ্রপন্থীদের পক্ষে ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব হতো না। তাই উগ্রপন্থার শিকড় সমূলে উৎপাটন করতে হলে এদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি।

একজন শিক্ষার্থী যখন জানবে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে (সা.) কেউ সবচেয়ে নিকৃষ্টতম গালি দিলেও তাকে হত্যা করার অধিকার তাকে ইসলাম দেয়নি। ওই গালি দেওয়া ব্যক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন অপরাধী তেমনি যিনি ইসলাম রক্ষার নামে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করছেন তিনিও অপরাধী; তখন তিনি আর ইসলাম রক্ষার নামে অন্যকে হত্যা করার অপরাধে অপরাধী হতে চাইবে না। ফলে উগ্রপন্থীরা আর কাউকে ধর্মের কথা বলে অন্যকে হত্যা করতে সহজে প্ররোরোচিত করতে পারবে না। তাই একথা নিসঙ্গচিত্তে বলা যেতেই পারে উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদকে রুখতে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার বিকল্প নেই।

পরিশেষে, আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক প্রগতিশীল শিক্ষাই পারে কথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদ রুখতে। তাই বর্তমান প্রচলিত মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষার কারিক্যুলামের বিষয়বস্তুকে সংস্কার করে আধুনিক প্রগতিশীল, মানবিক ও  বিজ্ঞান নির্ভর কারিকুলাম প্রণয়ণে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ