X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: ব্যবসায়ী শ্রেণির মানসিকতা ও ‘ম্যানেজ’ সংস্কৃতি

মাকসুদুল হক
২০ জুন ২০২১, ১৪:১৩আপডেট : ২০ জুন ২০২১, ১৬:৪৭

মাকসুদুল হক ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’— প্রচলিত প্রবাদবাক্য

১. সমাজের নতুন শ্রেণিবিন্যাস:

গত ১৫ বছরে সমাজে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে আমাদের অজান্তে, একেবারে দৃষ্টির অগোচরে। আজ সমাজের বাস্তবিক চিত্র বিগত দিনগুলোর মতো স্বচ্ছ নয় এবং নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সাধারণ (ও অপমানকর) শ্রেণিবিন্যাস করতে আমরা যে অভ্যস্ত ছিলাম, তা আর ধোপে টিকছে না। এর বদলে উঠে এসেছে কেবল দুটা শ্রেণি যথা ‘হ্যাভ নটস’ বা যাদের কিছুই নেই, আর ‘হ্যাভ প্লেনটিজ’ বা প্রাচুর্যে ভরপুর অভিজাত শ্রেণি। এছাড়া মহামারির মাঝে ‘নব্য দরিদ্র শ্রেণির’ আবির্ভাব রাষ্ট্র স্বীকৃত।

অনস্বীকার্য যে এই অভিজাত শ্রেণি একটি ক্ষুদ্র অংশ তাদের দাপট ও অশ্লীলতায় রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যবসা, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির মসনদ বহু যুগ আগেই দখল করেছে। এদেরই সাফল্যের গুণকীর্তন ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ থেকে ‘মধ্যম আয়ের দেশে’ নিহিতার্থে পোলভল্ট করার অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’র গল্প জনগণকে দিবানিশি গিলতে হচ্ছে।

আপামর জনগণকে এসব ক্ষমতাবান লোকদের সব কর্মের প্রতি থাকতে হবে কৃতজ্ঞ, এবং অনুগত্য—চলমান সংস্কৃতিতে এই ভ্রান্ত ধারণাই ঘুরেফিরে পরিস্ফুটিত, জমাটবদ্ধ ও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

এর অপ্রত্যক্ষ অর্থ—কিছু ভিআইপি, সিআইপি ছাড়াও শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা শ্রেণির মাঝেমধ্যে ঘটতে থাকা ‘অনিচ্ছাকৃত ছোটখাটো ভুল’ যেমন- খুন, গুম, ধর্ষণ, জমিজমা, খালবিল নদীনালা দখল, বিদেশে মানব ও টাকা পাচার, কালো টাকা সফেদ করা, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ট্যাক্স ফাঁকি ইত্যাদি কীর্তি নির্বোধ জনগণ হাসিমুখে মেনে নিতে বাধ্য। তারা সবাই আইনের ঊর্ধ্বে ও কারো কাছেই তাদের জবাবদিহির প্রয়োজন পড়ে না। এক মৃত্যুসম্বন্ধীয় অসহায়ত্ব ও হতাশা ছেয়ে গেছে সমগ্র দেশে।

জাতিগতভাবে অন্যের ‘চরিত্র’ ঘাঁটাঘাঁটি করার কুৎসিত বদভ্যাস থাকলেও আমাদের নিজেদের ভণ্ডামি চরিত্রই বা কী, তা সমালোচনা বিদ্যায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তর্জনী অপরের দিকে তাক করলে মধ্যমি, অনামিকা ও কনিষ্ঠা যে পাল্টা আমাদের দিকেই তাক করা থাকে, তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। সবকিছুতেই ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখানো এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।

২. শ্রেণিগত দ্বন্দ্বে ‘শিক্ষিত’ সমাজের ভূমিকা:

শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের অত্যন্ত দুর্বল মধ্যবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল লিংকে অবস্থান রয়েছে আমাদের মতো তথাকথিত ‘শিক্ষিত শ্রেণি’, যাদের কাজ হলো দূর থেকে সব অবলোকন করা, দু’চার দিস্তা জ্বালাময়ী কলাম, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়-সহ ফেসবুক স্ট্যাটাস লেখা...। ব্যস...তাতেই “সামাজিক দায়বদ্ধতা”-র ল্যাঠা চুকে যায়।

এছাড়া আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে থাকলে একটু সাহস বুকে জন্মায়। আমরা চে গুয়েভারা টি-শার্ট পরে, কুল অ্যান্ড সেক্সি বিপ্লবীর বেশ ধরে, ‘ঝামেলামুক্ত’ শাহবাগ চত্বর কিংবা প্রেসক্লাবের আশপাশের নিরাপদ অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করি। পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন সমৃদ্ধ সেলফি তোলা মানববন্ধনে যোগ দিয়ে যেকোনও ইস্যুতে নির্বিচারে ‘একাত্মতা’ প্রকাশ করি। আবার কালেভদ্রে ‘বিপ্লবী চেতনায়’ তুমুল বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধ করে মাইলের পর মাইল ‘যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখি... হুমম’।

পজিটিভ বিষয় হলো, ঘটনা একটু ‘সিরিয়াস’ হয়ে গেলেও আমাদের কোনও সমস্যা নেই। যেমন, পুলিশের লাঠিচার্জ-এর মুখে ছত্রভঙ্গ হওয়ার দৃশ্যাবলি ত্বরিত ফেসবুক লাইভে আপলোড দিয়ে–“ফ্যাসিস্ট, জুলুমবাজ, দুর্নীতিপরায়ণ সরকার”-কে নিয়ে সমালোচনা করার পর আরেক পুনরাবৃত্তিমূলক ড্রামা শুরু করি।

পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ‘ক্ষোভ, দুঃখ, ঘেন্না’ প্রকাশ করার পর অন্যায়ের সুবিচার না হওয়া পর্যন্ত, কিছু ঘণ্টার আল্টিমেটাম বেঁধে আগামীতে ‘কঠোর ও লাগাতার আন্দোলন’-এর ডাক দিয়ে কাছিমের মতো মাথা লুকিয়ে ফেলি।

এ হলো আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’-এর বাস্তবিক স্যাম্পল। তবে রাষ্ট্র বা অভিজাত শ্রেণি এসব প্রতিবাদ একটুও পাত্তা দেয় না। কারণ, ‘সিচুয়েশন ম্যানেজ’ করার কৌশলে তারা সিদ্ধহস্ত।

সবকিছুই কমবেশি ‘গণতান্ত্রিক’ কায়দায় হলেও—অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে আমাদের ‘বিপ্লবীগণ’-এর গোপন আঁতাতের ভিত্তিতে দফারফা করে অলিখিত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সমস্যাগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়। এ হলো ‘ম্যানেজ সংস্কৃতি’র বৈজ্ঞানিক স্যাম্পল। তবে এইস ম্যানেজে বাগড়া দিতে আরেক বিপ্লবী গোষ্ঠী স্ট্যান্ডবাই থাকে।

‘আজকের ঘুণেধরা সমাজের প্রকৃত চিত্র’-এর হট টপিক আলাপ করতে সন্ধ্যার পর ‘বিশেষজ্ঞগণ’ ঝটপট বসে পড়েন টকশো নামের ‘সুশীল সমাজের’ অতি ফ্যাশনেবল ‘আঁতেলেকচুয়াল’ চিত্তবিনোদনের মহামচ্ছবে। এখানে সরকার, রাষ্ট্র, বিরোধী দল, পুলিশ, আমলাতন্ত্রকে তুলাধুনা করা ও চাটুকার বুদ্ধিজীবী বা সাংবাদিক, পর্যালোচকদের কর্কশ চিৎকার জনগণকে একরকম কান ধরে উঠবস করিয়ে শুনতে বাধ্য করা হয়।

এই ‘নির্যাতন’ বলবৎ রাখতে ঘুরেফিরে সেই একই দেড় ডজন লোক সব চ্যানেলে উপস্থিত থাকে। বাংলাদেশে মেধাবী লোকের আসলেই কি এতটা সংকট পড়েছে? এসব বাসী মুখ দেখতে দেখতে ও প্রেডিকটেবল কথা শুনতে শুনতে জনগণ ক্লান্ত। সে-যাক।

৩. বাংলাদেশের ব্যবসার অতীতকথন:

ব্যবসাকে আমি কখনোই ‘অশ্লীল’ শব্দ মনে করিনি এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। অপরদিকে ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। এই শ্রেণির বিস্ময়কর উত্থান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল বলে আমি মনে করি।

১৯৭১-এর আগে বাঙালি ব্যবসায়ী ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন। রাজনৈতিক ছাড়াও অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র বলে গ্রহণ করা হয়—কারণ, পাকিস্তানি ধনিক ২১টি পরিবারের হাতে পূর্ববঙ্গের সমস্ত ব্যবসা ও জনগণের ভাগ্য জিম্মি ছিল। বাঙালিদের সেখানে দাঁড়িয়ে ওঠাটা ছিল অসম্ভব।

১৯৭১ পরবর্তী গেলো ৫০ বছরে বাঙালির ব্যবসায়িক প্রতিভার বিকাশ সত্যি অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। প্রচুর প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আমাদের ব্যবসায়িক বিপ্লব সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে, যার স্বত্বাধিকারী আমাদের আজকের প্রজন্ম, জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্র।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কর্মসংস্থান ছাড়াও কোটি কোটি মানুষের আজকের সুখ ও সমৃদ্ধি, রাষ্ট্রের একার পক্ষে কৃতিত্ব এসব বেসরকারি ব্যবসায়ীদের যোগসূত্র ছাড়া সম্ভব হতো না। তাই ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীকে গালিগালাজ দেওয়ার পক্ষে আমি নই।

৪. ব্যবসার মান ও সম্প্রসারণ:

যেকোনও বিদেশি কোম্পানির সমতুল্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মান তারা ধরে রাখে পণ্য বিক্রয় বা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। তাদের উৎকৃষ্টতা ও দক্ষতা বাংলাদেশকে ব্যবসার জগতে এমন এক জায়গায় উপনীত করেছে, যেখান থেকে আমাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি রুদ্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই। বিদেশি পুঁজির বিরুদ্ধে দেশীয় পুঁজির লড়াই আজ অন্য লেভেলে—আমরা আকাশকে এখনই চুম্বন করতে পারছি।

বহির্বিশ্বে বহু বাংলাদেশি কোম্পানি সদর্পে অবস্থান করছে এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং আজ জাতীয় পতাকার পাশাপাশি আমাদের বীর জাতির অস্তিত্বর প্রতীক।

৫. বাংলাদেশের ব্যবসার দুর্বৃত্তায়ন:

তাহলে আজকের কিছু ব্যবসায়ীদের নৈতিক ও মানবিক অধঃপতন এই ‘লাফাঙ্গাপনার’ সূত্রপাত হলো কী করে? কী করে পাকিস্তানি ২১টি পরিবারকে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে আমরা বাংলাদেশে ২১০০ নাকি ২১০০০ পরিবার সৃষ্টি করলাম? এর ঐতিহাসিক অধ্যয়ন কি সমাজবিজ্ঞানীরা করেছেন?

পৃথিবীর সব দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা সবসময় ছিল এবং থাকবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ব্যবসায়ীদের অর্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে—বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে।

সামরিক স্বৈরশাসন আমল থেকে নব্য ব্যবসায়ী শ্রেণির দুর্বৃত্তায়ন ও আস্ফালনের উত্থান। ক্ষমতার করিডোরে থেকে টেন্ডারবাজি, ঘুষ, সরকারের খরচের ওভার ইনভয়েসিং করে তিন/চারগুণ বেশি দেখিয়ে, কাট, কমিশনসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফায়দা লুটা, অযাচিত ক্ষমতা দ্বারা বল প্রয়োগ, সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারি ইত্যাদি ব্যবসা—এ সবকিছুই ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে।

তবে ভূমিদস্যুতা রাষ্ট্রসহ জনগণকে একেবারে পঙ্গু করে উপড়ে ফেলার দুঃখ-কষ্ট আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কত হাজার একর সরকারি জমি দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও আইন রক্ষাকারী সংস্থার বৃহৎ মাথাদের সহযোগিতায় দখল হয়ে গেছে তার তালিকা আমাদের লজ্জায় ফেলে দেয়।

কিন্তু নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয় ‘ব্যবসা’র আড়ালে দেশের ভেতরে ও বাইরে ‘নারী পাচারের’ মাধ্যমে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টাকার ঘুষ ছাড়াও এই উৎকোচ গ্রহণে বাড়তি সুবিধা দু-পক্ষেরই থাকে–

এক. এই ঘুষের কোনও প্রমাণ থাকে না;

দুই. সুবিধা আদায় করতে না পারলে আমলাদের ব্ল্যাকমেইল করার এ সবচাইতে সহজ ও উত্তম পন্থা।

ভবিষ্যতে দুর্নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার এক ধরনের নীরব আঁতাত চলছে। এই নির্মম বাস্তব বর্বরতার শিকার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খেটে-খাওয়া দেশের ৮০ ভাগ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। আজ গরিবের কন্যাদের দেহ ব্যবসায় লগ্নি খাটানো হচ্ছে — তাতে কারও আত্মা একটুও কাঁপে না। প্রতি বছর কত হাজার নারী দেহ ব্যবসার দালালদের দ্বারা বিদেশে পাচার হচ্ছে তার হৃদয়বিদারক কাহিনি প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় পড়তে হয়।

৬. বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও অবমূল্যায়ন:

নারী ক্ষমতায়নের বহু উজ্জ্বল ও যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত থাকলেও সমাজের তথাকথিত ‘সুন্দরী নারীদের’ বিশেষ করে গ্রাম্য বা নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা কমবয়সী মেয়েদের ‘গেট রিচ কুইক ফর্মুলা’ বা দ্রুত ধনী হওয়ার ফাঁদে ফেলে অপব্যবহার করার উদাহরণ আজ সমাজে সর্বত্র। ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে বিদেশ সফরের সঙ্গী হয়ে কিছু নারীদের যাওয়া-আসা, বা দেশের অভ্যন্তরে রাতযাপন —সমাজে এখন সবই ওপেন সিক্রেট।

৭. ইয়াবা, ক্যাসিনো ও জুয়া:

এই এক ইয়াবা ব্যবসা করে কত হাজার ‘নব্যধনী’ সৃষ্টি হয়েছে তা কক্সবাজার অঞ্চলে ঘুরলেই বহু স্থাবর সম্পত্তির প্রমাণ মেলে। লাইনকে লাইন ইয়াবা গডফাদারদের ‘প্রাসাদ’ ইঙ্গিত করে কী পরিমাণ কাঁচা টাকার চালাচালি চলছে।

কিন্তু অবাক কাণ্ড, ইয়াবার সাপ্লাই চেইনের সবচেয়ে বহু দূরবর্তী লিংক—নিম্নবর্গের বস্তিবাসীদের রাষ্ট্রের মাদকবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স পলিসির’ আওতায় ধরে ধরে ক্রসফায়ার করা হলেও গডফাদারদের ‘সসম্মানে আত্মসমর্পণ’ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে ইয়াবা ব্যবসা থেমেছে বা কমেছে তেমন কোনও প্রমাণ নেই, এমনকি গডফাদারদের বিরুদ্ধে আইনি মামলার হালহকিকত কী—তা নিয়ে নেই কোনও আপডেট।

অপরদিকে সম্প্রতিকালের ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে প্রচুর ‘হুলস্থুল’ হলেও সব বড়-বড় ‘বুলিবাজ’দের আওয়াজ আজ স্তব্ধ; কারণ —জুয়া বন্ধ হয়নি। ক্লাব থেকে জুয়া উধাও হয়ে শিফট করেছে নগরীর বিলাসবহুল হোটেলসমূহে। সেখানে রুমে রুমে চলছে ক্যাসিনো খেলা, মদ, ইয়াবাসহ চামড়ার রমরমা ব্যবসা।

যেকোনও হোটেলের লবিতে সন্ধ্যার পর তরুণীদের ভিড় দেখার মতো। মেকআপসহ ডিজাইনার কাপড়চোপড়, রকমারি পারফিউমের সুবাস, হাতে মূল্যবান ব্যাগ ও গ্যাজেট প্রমাণ করে—বেআইনি হলেও ঢাকা শহরের স্পন্দনশীল ‘নাইট লাইফ’ বিদেশের যেকোনও শহরের তুলনায় কোনও অংশে কম না।

অভিজাত শ্রেণি এই মহামারির কারণে পড়ে গেছে মহাবিপদে। একটু আরাম-আয়েশ ফুর্তি এবং বাতাস পরিবর্তন করতে তাদের নিয়মিত ব্যাংকক, দুবাই, মুম্বাই, দিল্লি, সিঙ্গাপুর যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ—তাই আর কী করার!

দেশেই তো ‘সীমিত পরিসরে’ ফুর্তি চালিয়ে যাওয়ার অনেক বিকল্প স্কোপ আছে। এক/দুটা ফোনকল করতে পারলেই তো মুশকিল আসান। এসব অপকর্মা ব্যবসায়ী শ্রেণির চোখে নারী মাত্রই ‘গনিমতের মাল’, তাই তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা এক ধরনের যৌক্তিক অধিকার তারা রাখে।

রাতে ঘোরাফেরা করা ‘দুশ্চরিত্রা’ নারীদের সমাজ এমনিতেই “ব ম খ” সূচক গালি দেয়—তাই “কুছ পারওয়া নাহি”। মুম্বাইয়ের সিনেমার ভিলেনদের মতো তাদের ওপর নিপীড়ন চালানো যায়। বাংলাদেশে তারাই তো মুকুটহীন ‘প্রিন্স’ বা ‘কিং’ আরও কত কী —তো কে থামায় কাকে? কার এত দুঃসাহস?

সাহস হঠাৎ বেড়ে গেলো। কারণ, নিরীহ একটি মেয়কে হত্যা (আত্মহত্যা?) করে/করিয়ে ধনাঢ্য গ্রুপের এক পরিচালক নিশ্চিন্তে দেশে বীরদর্পে ‘হাই সোসাইটি’-তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

তবে হ্যাঁ, সব সহজ সমীকরণ পাল্টে দিয়ে সেই দুঃসাহস, জোরালো প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা একজন অভিনয় শিল্পী অতি সম্প্রতি দেখিয়েছেন। নারীগণ সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করে যাবে—সেদিনের সমাপ্তি নিশ্চয়ই ঘনিয়ে আসছে। এখন দেখার অপেক্ষায় থাকলাম শিল্পী আসলেই কি সুবিচার পাবেন, নাকি ম্যানেজের খপ্পরে পড়বেন। পড়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই!

৮. লাম্পট্যের সর্বদলীয় ঐক্য:

অদ্ভুত বিষয় হলো, ব্যবসা ও চরিত্রহীনতার ক্ষেত্রে ‘সর্বদলীয় ঐক্য’র এক নিরভিমান নিদর্শন দেখা যায়, যা রাজনীতির ময়দান থেকে বহু বছর আগে গুম হয়ে গেছে। এখানে কেউ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত এমনকি হেফাজতও না। এখানে সবাই ‘জিগরি ভাইব্রাদার’।

শিহরণ যখন শরীরকে ঝাঁকি দেয় তখন জাতপাত, স্তর, গোত্র, শ্রেণি, আত্মীয়তা, অনুমতি বা দেশের রাজনীতি—সে কোনও কিছুরই ধার ধারে না। ‘মিলিয়া মিশিয়া করিব কাজ, নাহি ভয় নাহি লাজ’।

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ