আনন্দ, দুঃখ এবং উদ্বেগ নিয়ে শুক্রবার দিবারাত্রি ফোন করেছে কতজন। এখনও করছে। দেশের ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে নেওয়া সংযোগে বিদেশি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেশি চ্যানেল দেখতে পেয়ে উল্লসিত কোনও কোনও দর্শক। তাদের মতে বিদেশি চ্যানেলের ভিড়ে দেশি চ্যানেলের অনেকগুলো দেখাই হয়নি। কতগুলোর নামও জানা ছিল না। এছাড়া বিদেশি কোনও কোনও চ্যানেলের প্রতি পরিবারের সদস্যদের এমনকি নিজেরও যে আসক্তি তৈরি হয়েছিল, তা থেকে মুক্তির পথ যেন খুঁজে পেলেন।
আরেকটি পক্ষ বিরক্ত। কেন বিদেশি চ্যানেল বন্ধ হবে? দেশি চ্যানেলেতো দেখার মতো কিছু নেই। খুঁজে পাচ্ছি না। না খবর। না অনুষ্ঠান। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। নিজেদের ভালো কিছু দেখানোর মুরোদ নেই, বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দিলো। উপায় বা সমাধান খুঁজে বের না করে মস্তক কেটে ফেলাকে তারা অপরিপক্কতা মনে করেন।
তবে সরকার বা তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগ যে এই সিদ্ধান্তে অর্থাৎ বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে ক্যাবল অপারেটরদের বাধ্য করছে, একে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ দর্শকদের অনেকেই। বিদেশি চ্যানেল নিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তা, মিডিয়া কর্মী এবং দর্শকদের অস্বস্তি ছিল। ক্যাবলে সকল চ্যানেলসুলভ হোক এমন চাওয়া ছিল না। কারণ প্রতিবেশি দেশের চ্যানেলের ধারাবাহিক, হিন্দি ভাষায় প্রচার করা কার্টুন চ্যানেল, প্রতিবেশি দেশের চ্যানেলের অপরাধমূলক অনুষ্ঠানের নেতিবাচক প্রভাব সমাজে কিশোর-তরুণসহ সকলের ওপরই পড়ছিল।
তাই ২০০৭ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, কিছুদিন কয়েকটি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধও ছিল, কিন্তু পরে আর চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার আটকে রাখা যায়নি। এরপরেও একাধিকবার বিদেশি চ্যানেলের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছু হটতে হয়েছে। কিন্তু এবার তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, অবস্থান থেকে তারা সরে আসবেন না। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি টেলিভিশন মালিক সংগঠন যেমন আছেন, তেমনি দৃশ্যমাধ্যমের পেশাজীবীরাও আছেন। ক্যাবল অপরাটেররা নিঃসন্দেহে শক্তিশালী সংগঠন। দেশের অর্থনীতি ও দেশীয় চ্যানেলকে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে তাদের প্রায় তিন দশকের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু দৃশ্যমাধ্যম শিল্প বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, তাদেরকেও সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। একদশকের বেশি সময় ধরে ক্যাবল অপারেটররা সংযোগ সরবরাহ কাজে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, তারা অবশ্যই বিজ্ঞাপন বিযুক্ত করার পদ্ধতিটিও রপ্ত করে নিতে পারবেন। এতে দৃশ্যমাধ্যম শিল্প ছাড়াও, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি লাভজনক হবে। কারণ বহুজাতিক কোম্পানির যে বিজ্ঞাপন আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। সেগুলো ফিরে আসবে আবার, নতুন বিজ্ঞাপন যোগ করেই। এতে স্থানীয় টেলিভিশনগুলোর স্বচ্ছলতা বাড়বে।
বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করার কোনও প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র সমাজে বিরুপ প্রভাব পড়ে সেগুলো বন্ধ রাখা যায়। বিশেষ করে অপরাধের দূরশিক্ষণ হিসেবে যেগুলোকে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে বিধি নিষেধ থাকতে পারে। কিন্তু বাকি সকল চ্যানেলে সম্প্রচার অবাধ হওয়া উচিত।
বিদেশি চ্যানেল থেকে বিজ্ঞাপন সরিয়ে নিলে সকল চ্যানেল লাভবান হবে। সকলের লাভের ঢেঁকুর দেওয়ার সুযোগ নেই। দেশের ৩৬টি চ্যানেলের মধ্যে কয়টির দর্শক চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা আছে? নিজেদের কাছে সত্য জবাব আছে? যদি প্রতিবেশি দেশ বা অন্য দেশের টেলিভিশনে বাংলাদেশের সংবাদ প্রচারের সুযোগ থাকতো, তবে কি আমাদের চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতো? প্রথমত দেশীয় চ্যানেলগুলোকে অনুকরণ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানসম্মত অনুষ্ঠান বা খবর তৈরির জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে তৈরি করতে হবে দক্ষ জনশক্তি। ৩৬টি টেলিভিশন আছে দেশে, উৎসব কেন্দ্র করে শ’ চারেক নাটক তৈরি হয়। সেখানে জনবল তৈরি কোনও ইন্সটিটিউট তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাও প্রশ্নবিদ্ধ। সুতরাং নিজেরা পুষ্টিকর অনুষ্ঠান তৈরি না করলে, দর্শক কোনোভাবেই ধরে রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে টেলিভিশন ছাড়াও দৃশ্যমাধ্যমের আরেকটি পণ্য এখন বাজার মাত করে রেখেছে ‘ওভার দ্য টপ’ বা ওটিটি। সেখানে কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই। আঙুলের স্পর্শেই দেশ বিদেশের ওটিটি মঞ্চে ঢুকে পড়া যাবে। এখান বলে রাখা দরকার, টেলিভিশনে পুষ্টি জোগান না দিতে পারলে, দেশীয় ওটিটিতেও পুষ্টিকর কিছু পাওয়া যাবে না। মূলকথা হলো, যেখানে স্বাদ নেই, সেখানে বিজ্ঞাপনও নেই। অতএব আমাদের দৃশ্যমাধ্যমকে আপন শক্তিতেই আলোকিত হতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী