X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেইনন্ট্রি ধর্ষণ মামলা: জরুরি আলাপ চাপা পড়লো ৭২ ঘণ্টার ‘হট্টগোলে’

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৮ নভেম্বর ২০২১, ২০:২৫আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ২০:২৫

ডা. জাহেদ উর রহমান বেশ কয়েক বছর আগে এই দেশে ‘৪৮ ঘণ্টা’ বিখ্যাত হয়েছিল। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ওই সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করবেন। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ এক দশক পূর্ণ হতে চললেও আসামিরা গ্রেফতার তো হয়ইনি, বরং মামলার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য সময় নিতে নিতে সেটা এখন সেঞ্চুরি পূরণ করতে যাচ্ছে। তাই আজও আমাদের সামনে ‘৪৮ ঘণ্টা’ ঘুরেফিরেই আসে।

ঠিক তেমনই, বেশ কয়েক দিন ধরে আমাদের মূলধারার এবং সামাজিক মিডিয়া মেতে আছে ‘৭২ ঘণ্টা’ নিয়ে। একদিকে পত্রিকায় রিপোর্ট হচ্ছে, আমরা আমাদের তাৎক্ষণিক মন্তব্য করছি, রাস্তায় এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, লেখা হচ্ছে মতামত-নিবন্ধও। দীর্ঘ চার বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে অতি আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণকাণ্ডের মামলার রায়ে বিচারক কামরুন্নাহার পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন এই বলে– ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পার হলে যেন ধর্ষণ মামলা নেওয়া না হয়। এই মন্তব্যের জন্য আলোচিত বিচারককে বিচারকার্য থেকে সাময়িকভাবে নিবৃত করা হয়েছে এবং তাকে প্রত্যাহার করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই বিষয়টি আপাতত শেষ হয়েছে বলা যায়। তবু এই প্রসঙ্গে দুটো কথা।

বিচারকের মন্তব্যটি নিশ্চিতভাবেই অর্বাচীন। এটি আইন তো বটেই, সংবিধানেরও পরিপন্থী। বুঝতে পারি, ওই সময়ের মধ্যে মেডিক্যাল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত (ফরেনসিক) পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে তিনি সে কথা বলেছেন। কিন্তু সাক্ষ্য এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ভিত্তিতেও ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হতে পারে। আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডটিতে মামলা হয়েছিল ধর্ষণের ৩৮ দিন পরে।

আপন জুয়েলার্সের মালিকের সন্তান সাফাত আহমেদ যখন একটি ধর্ষণ মামলার মুখোমুখি হলেন সেটা দেশজুড়ে খুব চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল। যেহেতু অত্যন্ত ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের জীবনযাপন নিয়ে আমাদের অনেকের চিন্তার এক ধরনের স্টেরিওটাইপ আছে, তাই আমরা অনেকেই সবকিছুর আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম সাফাত এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এবং ঘটনার ভিকটিম যেহেতু আর্থসামাজিক মানদণ্ডে সাফাতের পরিবারের চাইতে অনেকটা নিচুতে অবস্থান করে, তাই সেই ভিকটিম যেন ন্যায়বিচার পায়, তার দাবিতে আমরা সোচ্চার ছিলাম।

কিন্তু বিচারে যখন সাফাতসহ সব অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হলো তখন আমরা ‘না বুঝেই’ ক্ষুব্ধ হলাম বিচারকের ওপর, বিচার ব্যবস্থার ওপর। আমাদের ক্ষুব্ধতা হয়তো অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেটা কি বিচারকের ওপরে হওয়ার কথা ছিল? 

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষটাও কিংবা সবচেয়ে ভয়ংকর ধর্ষকটিও কোনও নির্দিষ্ট ধর্ষণ করেছে কিনা সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। অতীতে কেউ বহু ধর্ষণ করলেও তাকে চোখ বন্ধ করে ধর্ষক বানিয়ে কোনও অপরাধের সাজা দেওয়া যায় না। এবং একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় ভয়ংকরতম অপরাধীরও ন্যায়বিচার পাবার অধিকার আছে। 

আমি মনে করি একটা নিম্ন আদালতের বিচারক যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটা নিয়ে আমরা বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। এটা রায় নয়, নির্দেশনা, যা মানতে প্রশাসন বাধ্য নয়। এই নির্দেশনা না মেনে কেউ ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা নিলেও সেটা দেশের অন্য সব আদালত, এমনকি সেই বিচারকের আদালতও বিচার করতে বাধ্য।

সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের ‘ঘোষিত আইন’ হাইকোর্ট এবং অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয়। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমনকি উচ্চ আদালত যদি আইন হিসেবে ঘোষণা না করে তাহলে তার ‘নির্দেশনা’ মানার বাধ্যবাধকতাও নেই অন্য কোনও অধস্তন আদালত/প্রশাসনের। 

ফিরে আসি আমার কলামের মূল প্রসঙ্গে– এ ডামাডোলের কারণে ধামাচাপা পড়ে গেলো যে অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো।

আমাদের দেশের আদালতের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আমাদের আছে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ন্যায়বিচার পায় না–এমন অভিযোগও আছে। কিন্তু আমরা তলিয়ে দেখি না, এই বিচার না পাওয়াটা কি সবসময় আদালতের কারণে? এই মামলাটির ক্ষেত্রে যতটুকু তথ্য আমি মিডিয়ায় পেয়েছি তাতে বলবো, আদালতের অন্তত এই ক্ষেত্রে একটা ন্যায়বিচার করার সদিচ্ছা ছিল। কেন সেটা তারা পারেননি তার জন্য যে বিচারক যে কথাটি বলেছেন, সেটাই আমার মনে হয় এই মামলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।

আদালতের রায় দেওয়ার পরে এই মামলায় মূল সমস্যা হিসেবে বলেছেন তদন্ত কর্মকর্তা প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাক্ষীদের হাজিরই করতে পারেনি। যেহেতু ঘটনাটিতে মামলা হয়েছিল ৩৮ দিন পরে, তাই ধর্ষণের কোনও মেডিক্যাল এভিডেন্স থাকার কথা নয়। তাই এই মামলাটি যদি প্রমাণ করতে হয় তাহলে প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাক্ষীর ওপরে ভিত্তি করেই হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা পারা যায়নি।

এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে সেটার বিরুদ্ধেও খুব শক্তভাবে কথা বলেছেন রায় প্রদানকারী বিচারক। তিনি স্পষ্টভাবেই প্রদত্ত চার্জশিটকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। সেই কারণেই এই চার্জশিটের ভিত্তিতে যে ৯৪ কার্যদিবস আদালতের ব্যয় হলো, তাতে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এভাবে আদালতের সময় নষ্ট করার বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছেন তিনি। 

আলোচিত রায়টি মনমতো না হওয়ার ফলে আমরা যারা আদালতের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করছি, তাদের জানা উচিত ফৌজদারি মামলায় ভালোভাবে বিচার হবে কিনা খুব বড় প্রভাবক হচ্ছে মামলার চার্জশিট। 

এখানে খুব বড় কয়েকটি প্রশ্ন হচ্ছে - এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার সঠিক তদন্ত হয়নি কেন? তদন্তে কিছু না পাওয়া গেলে সেই চার্জশিট জমা দেওয়া হলো কেন? চার্জশিট জমা হওয়া নিয়ে যখন শুনানি হয়, তখন কি এই চার্জশিট গ্রহণ করার বিরুদ্ধে ‘না রাজি’ দিয়ে আবার তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী?

এই প্রসঙ্গে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জনাব মোখলেসুর রহমান। এই মামলা প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, অনেক সময় পুলিশ চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে তদন্তে তেমন কিছু না পেলেও সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় জনমতের চাপে। অর্থাৎ জেনে শুনে তারা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মিথ্যা চার্জশিট দেয়। তারা সম্ভবত চায়, যা হয় সেটা যেন আদালতে গিয়েই হয়। এবং তারপর যথারীতি জনগণের ক্ষোভ গিয়ে পড়বে আদালতের ওপর, বাঁচবে পুলিশ।

বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি হয় না অসংখ্য মামলা। আর নিষ্পত্তি হওয়া মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্তের সাজাপ্রাপ্তির হার মাত্র ৩ শতাংশের মতো। এটা শুধু ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রেই না, অন্যান্য ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও সত্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিযোগে একই - মামলায় দায়সারা, ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিট, সাক্ষীদের হাজির করতে ব্যর্থতা ইত্যাদি।

আমরা এখনও দেখি বহু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। এটা আমরা বুঝি, তদন্ত করার কাজ বিচার বিভাগের নয়, তাই এটা অনেক বেশি হতে পারে না। কয়েক বছর আগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গঠন করা হলেও সেটা পুলিশেরই বিভাগ। কিছু ভালো তদন্ত করলেও পুলিশি তদন্তের যে দুর্নাম সমাজে আছে, এর মাধ্যমে সেটার সুরাহা করা যাবে বলে আমি মনে করি না। পুলিশি তদন্তের যখন এই অবস্থা তখন আমাদের সম্ভবত এই আলাপ তোলার সময় হয়েছে, পুলিশের বাইরে স্বাধীন কোনও তদন্ত সংস্থা গঠন কেন করা হবে না।

মূল আলোচনা শেষ, তবে আরেকটি কথা বলে রাখতে চাই, যেটা আমাদের অনেকের চোখে না পড়লেও রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলোচিত বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী। মিডিয়ার সঙ্গে তিনিই কথা বলেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। যেহেতু এটা নিম্ন আদালতের ঘটনা, সরকার এই ব্যাপারে কথা বলতে পারে (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৫, ১১৬)। 

সাংবিধানিকভাবেই নিম্ন আদালতে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ আছে, কিন্তু এটা সংবিধানেরই বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের নীতির (অনুচ্ছেদ ২২) পরিপন্থী। নাগরিক হিসেবে আমাদের আরেকটা জরুরি সংগ্রাম হবে নিম্ন আদালতেও যেন সরকারের ন্যূনতম কোনও প্রভাব না থাকে - সাংবিধানিক, আইনগতভাবে নিম্ন আদালতসহ পুরো বিচার বিভাগ একেবারে স্বাধীন হবে। 

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ