X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাশিয়া-পশ্চিমা প্রক্সি যুদ্ধে বলির পাঁঠা ইউক্রেন

মো. জাকির হোসেন
০৩ মার্চ ২০২২, ২০:৪৮আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২২, ২০:৪৮

মো. জাকির হোসেন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির মধ্যে যুদ্ধ কিংবা প্রক্সি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুই মেরুতে বিভক্ত ছিল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান আর অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ব্লকে পূর্ব ইউরোপ, কিউবা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এই বিভক্তি বাই-পোলার পলিটিক্স ও দুই শিবিরের আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই (কোল্ড ওয়ার) নামে সমধিক পরিচিত ছিল। সোভিয়েত আদর্শের কমিউনিজম ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক হেন কোনও কৌশল নেই যা প্রয়োগ করেনি। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল সংকটের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে দু’টি রাষ্ট্র পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র ইতালি ও তুরস্কে ব্যালিস্টিক মিসাইল স্থাপন করেছিল।

অন্যদিকে, সোভিয়েত সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তাক করে কিউবায় অনুরূপ মিসাইল বসিয়েছিল। রাশিয়া আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে শামিল হয়ে আল-কায়েদা সৃষ্টি করেছিল। প্রক্সি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদাকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ ঘাঁটি স্থাপন করার সুযোগ দিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে মরণ কামড় দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ইভিল এম্পায়ার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি কমিউনিজমের ধ্বংস ও স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির লক্ষ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী ‘রিগ্যান ডকট্রিন’ প্রকাশ করেন। প্রথমদিকে তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সোভিয়েত সামরিক বাজেট আরও বৃদ্ধি করতে হয়। যা সোভিয়েত অর্থনীতিকে ভয়ংকর দুর্বল করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য কোনও একক কারণকে দায়ী করা যায় না। অনেক কারণ একে অপরের সঙ্গে মিলেছে। তবে পশ্চিমাদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ভূমিকা রেখেছে। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে রাশিয়া, ইউক্রেন, লিথুয়ানিয়া, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, কিরগিজস্তান, রাশিয়া, বেলারুশ, মলডোভা, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, লাটভিয়া, তাজিকিস্তান, আর্মেনিয়া, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তান ১৫টি রাষ্ট্র গঠিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আগে এই রাষ্ট্রগুলো তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমান রাশিয়া যেহেতু নিজেকে রুশ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সভ্যতাগত উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে, সেহেতু এই বাকি ১৪টি রাষ্ট্রকে রাশিয়া নিজস্ব ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অ-রুশ ভূখণ্ডগুলোকে রাশিয়া একত্রিতভাবে ‘নিকট বিদেশ’ (near abroad) হিসেবে অভিহিত করে এবং নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।

কমিউনিজমের পতনের পর রাতারাতি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লো, তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এক চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে রাশিয়া। এই অর্থনৈতিক দুর্দশা দীর্ঘ হওয়ায় বৈশ্বিক ব্যবস্থায় রাশিয়ার প্রভাব প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের একচেটিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও আইন ব্যবস্থা ভয়ংকর রকমভাবে অগণতান্ত্রিক, শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও নির্মম হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বৈশ্বিক ব্যবস্থায় পশ্চিমা রাষ্ট্রের মাফিয়াতন্ত্র তৈরি হয়, যার মাধ্যমে তারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সম্পদ শোষণ করে এনে নিজেদের রাষ্ট্রে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আর এই প্রক্রিয়ায় কিছু রাষ্ট্র দরিদ্র থেকে নিঃস্ব হয়েছে। আফ্রিকায় যে ভয়ংকর দারিদ্র্য বিরাজ করছে তার জন্য আফ্রিকা দায়ী নয়। আফ্রিকা দরিদ্র নয়, তাকে দরিদ্র করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকায় বিশ্বের খনিজ সম্পদের ৩০ শতাংশের মজুত রয়েছে। এসব খনিজের মধ্যে আছে ডায়মন্ড, গোল্ড, কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, তেল ও গ্যাস। গত দশকগুলো খনিজ সম্পদের মূল্য প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আফ্রিকার ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ভয়ংকর দারিদ্র্যের সঙ্গে বাস করছে। কেন এমন হলো? কারণ, আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের প্রত্যক্ষ মদতে ও সহযোগিতায় অনেক ওয়ার লর্ড ও মার্সেনারি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর ফলে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ, হিংসা-বিদ্বেষ, রক্তপাত আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে রেখেছে। আর এ সুযোগে ওই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দোসর বহুজাতিক কোম্পানি নানা কৌশলে আফ্রিকার সম্পদ পাচার করে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ষাটের দশকে উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ বৈশ্বিক শোষণ টিকিয়ে রাখতে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান, কৌশল, তত্ত্ব আবিষ্কার করে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), ব্যাপক হারে বহুজাতিক কোম্পানি, এনজিও, মুক্তবাণিজ্য, বাণিজ্য উদারীকরণ, ডিরেগুলেশন, প্রাইভেটাইজেশন, বিশ্বায়ন ইত্যাদি।

শোষণকে আড়াল করতে প্রতারণামূলকভাবে জন্ম দেওয়া হয় দরিদ্র রাষ্ট্রকে এইড প্রদান, Structural Adjustment, Poverty Reduction and Growth Facilities (PRGF), Poverty Reduction Strategic Paper (PRSP), Millennium Development Goals (MDGs), Sustainable Development Goals (SDGs)। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Share The World's Resources (STWR)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রাপ্তির বিপরীতে ২০০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে থাকে। এটি মূলত ঋণ পরিশোধ, শোষণমূলক বাণিজ্য, বাণিজ্য উদারীকরণ, ঋণদাতা রাষ্ট্রের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয়, ধনী রাষ্ট্রের পছন্দমতো বহুজাতিক কোম্পানিকে দরিদ্র রাষ্ট্রে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া ও তাদের ঠিকাদারি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া, ধনী রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে শিল্পের কাঁচামাল বিক্রিতে দরিদ্র রাষ্ট্রকে বাধ্য করা, শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ, উচ্চ কনসালটেন্সি ফি ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (UNCTAD)-এর হিসাব মতে, বৈশ্বিক অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক বাণিজ্য ব্যবস্থার কারণে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিদিন ১১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জাতিসংঘের হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ এইড হিসেবে ধনী রাষ্ট্রদের কাছ থেকে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো যা পেয়ে থাকে তার ১৪ গুণ বেশি। UNCTAD-এর তথ্য মতে, দরিদ্র ৪৯টি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ অথচ বৈষম্যমূলক বাণিজ্যের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ৪৯টি রাষ্ট্রের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। Jason Hickel গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখিত Aid in reverse: how poor countries develop rich countries শিরোনামের প্রবন্ধে অংক কষে দেখিয়েছেন, দরিদ্র রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যাপক হারে ধনী রাষ্ট্রে পাচার হচ্ছে। Jason Hickel বলেছেন, ধনী রাষ্ট্রগুলো উচ্চকিত কণ্ঠে বলে তারা ১২৫ বিলিয়ন ডলার এইড দিচ্ছে প্রতিবছর, অথচ এই ১২৫ বিলিয়ন ডলার পুরোটা এইড নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা Global Financial Integrity (GFI) ও নরওয়ের স্কুল অব ইকোনমিকস এর Centre for Applied Research-এর তথ্য মতে, এইডের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, ঋণ বিলোপ, রেমিট্যান্স, পুঁজির পলায়ন সবকিছুকে এইড হিসেবে দেখিয়ে পরিমাণকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। Jason Hickel স্পষ্ট করে বলেছেন ‘Rich countries aren’t developing poor countries; poor countries are developing rich ones.’ তিনি দেখিয়েছেন দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো যদি ১ ডলার সাহায্য পায় তার বিপরীতে ২৪ ডলার তাদের দেশ থেকে পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। তিনি রাখঢাক না করে সরাসরি বলেছেন, ‘In other words, some of the very countries that so love to tout their foreign aid contributions are the ones enabling mass theft from developing countries.’ ফিলিপিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এনজিও IBON International তাদের Primer on Development and Aid Effectiveness প্রবন্ধে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রকে ভয়ংকরভাবে শোষণ করছে তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ৬০টি দরিদ্র রাষ্ট্র তিন দশকে ৫৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে সুদ ও মূলধন মিলিয়ে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। কিন্তু এখনও এসব রাষ্ট্রের কাছে পাওনা রয়েছে ৫২৩ বিলিয়ন ডলার। এই ভয়ংকর শোষণমূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও একচেটিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহকে অনেক নিষ্ঠুর, অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধ তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করা, বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতাদের হত্যা করা, ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রাইকা’র বটিকা সেবন করিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে কয়েক টুকরো করা, দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে বশংবদ গোষ্ঠী তৈরি করা, রাষ্ট্রদূতদের ব্যবহার করে শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতিতে নাক গলানো, নোবেল পুরস্কারের মাল্যভূষিত করা, আরও কত কী।

কয়েক দশক পর রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে শুরু করলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর একে পশ্চিমারা তাদের একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমারা আগে বৈশ্বিক সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে খেতো। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির দৃশ্যপটে রাশিয়া ও চীনের আবির্ভাবের ফলে শোষণ ব্যবস্থায় ও সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারায় এই দুটি রাষ্ট্রও থাবা বসাতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমাদের একচেটিয়াতন্ত্র যদি থাকতো তবে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, হাইটেক পার্ক, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগা প্রজেক্টগুলোতে চীন কিংবা রাশিয়া নয়, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্ররা যুক্ত হতো। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চাইছে যেকোনও মূল্যে রাশিয়া ও চীনকে চাপে ফেলতে হবে, যাতে তারা বৈশ্বিক রাজনীতির নিয়ামক হয়ে না উঠতে পারে। এরই অংশ হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে নানা বাণিজ্যিক সীমাবদ্ধতা আরোপ ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।

অন্যদিকে রাশিয়াকে চেপে ধরতে ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য করে একেবারে রাশিয়ার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক অভিযান সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে এমন সামরিক অভিযান তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ডাল-ভাত। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যেমন একতরফা ইরাক কিংবা আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল, রাশিয়াও তেমনি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে এখন যেরূপ নিষেধাজ্ঞার হোলি উৎসব শুরু করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দূরে থাক, সামান্যতম নিন্দাও করেছিল কি? করেনি। কারণ, ডাকাতে-ডাকাতে মাসতুতো ভাই। আর যত দোষ, শি জিন পিং ও পুতিন ঘোষ! পশ্চিমাদের হাতের পুতুল হয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদেমির জেলেনস্কি ন্যাটোর সদস্য হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এটি একদিকে যেমন রাশিয়াকে সামরিক অভিযানের দিকে উসকে দিয়েছে, অন্যদিকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার মাধ্যমে রাশিয়া ও ইউক্রেন চিরস্থায়ী শত্রুতে পরিণত হবে বলে ধারণা করা যায়। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেশ দুটির উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। চিরবৈরী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণে দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ভারত ও পাকিস্তানে সামরিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হলেও সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপক দারিদ্র্য রয়েছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন।

ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ মিলিয়ে ৭০ কোটির বেশি মানুষ অনাহারে, চূড়ান্ত কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিরাট সংখ্যক মানুষের কাজের সংস্থান নেই। কৃষক, শ্রমিক, কর্মহীন অসংখ্য মানুষ ঋণের ভারে বিপর্যস্ত। এই ভয়ংকর ব্যবস্থায় বেঁচে থাকতে না পেরে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ কেবল এ দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া এর দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে সার্কভুক্ত অন্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বাজারে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তার ফলশ্রুতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা। ন্যাটোকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ইউক্রেন দ্বৈরথ যেন ওই অঞ্চলের স্থায়ী দুঃখ হিসেবে আবির্ভূত না হয়।

আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধের প্রভাব কেবল রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যে সীমিত নয়। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের নিরপরাধ মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের একজন প্রকৌশলীও নিহত হয়েছেন। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ ভয়ংকর দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। আর তেমনটি হলে ভয়াবহ বৈশ্বিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশের রাষ্ট্রনায়ককেই অবিমৃশ্যকারিতা ছেড়ে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের ভেন্যু চূড়ান্ত
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের ভেন্যু চূড়ান্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ