X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

লৈঙ্গিক সমতা বহু দূরেই…

জোবাইদা নাসরীন
০৮ মার্চ ২০২২, ১২:৩৪আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ১২:৩৪

জোবাইদা নাসরীন আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২  পালনের এবারের থিম হলো ‘নারী-পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূল কথা’। যদিও গত দুই বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশে ৮ মার্চ সেভাবে পালন হয়নি। প্রতিবছর বাংলাদেশে মার্চের প্রথম দিন থেকেই বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন আঙ্গিকে এই দিবসটি পালন শুরু করে এবং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য থাকে বিভিন্ন নারী সংগঠনের উদ্যোগে ৭ মার্চ রাতে শহীদ মিনারে জমায়েত, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অপেক্ষা করে। কারণ এই দিনটিই তারা শুধু রাত ১১ টার পর হলের বাইরে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থাকতে পারে। নিজেকে পরাধীন ভাবার জায়গা থেকে একটু সরে আসতে পারে।

এই অনুষ্ঠানের প্রতীকী তাৎপর্য হলো নারীর জন্য শুধু দিন নয়, রাতও নারীর। কারণ ‘নারী রাতে বাইরে গেলো কেন?’ কিংবা কয়েকদিন আগেও আমরা দেখেছি ‘রাতের রানী’র তকমা লাগিয়ে প্রশাসনিকভাবে যেভাবে হেয় করা হয়েছে,  সেগুলোর প্রতিবাদই যেন  ছিল  নারীদের রাতের এই অনুষ্ঠান।

গত দুই বছর এই অনুষ্ঠান করা যায়নি করোনার কারণে। এবারও বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্নভাবে শুরু করেছে ৮ মার্চ পালন। এবারের থিমটি এই প্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিপ্রাদ্য বিষয়ের প্রতি যদি আমরা দৃষ্টি দেই তাহলে কী দেখবো? এবারের মূলে আছে ‘লৈঙ্গিক সমতা’। বাংলাদেশে জেন্ডার গ্যাপ কিংবা লিঙ্গীয় সমতা দেখার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় দেখা হচ্ছে। প্রথমত মাঝখানের ২ বছর বাদ দিলে বাংলাদেশে গত ত্রিশ বছর নারী শাসন চলছে। বর্তমান সংসদে মাননীয় স্পিকারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেই আছেন নারীরা।  প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ এবং নারীরা প্রশাসনের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তাতেই কি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, বাংলাদেশে লৈঙ্গিক সমতা বেড়েছে? নিশ্চিতভাবেই নয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২১ এর ১৫৬টি দেশের মধ্যে ৬৫তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এবং আপাতভাবে মনে করা হচ্ছে যে এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে বাংলাদেশ।

কেন লিঙ্গীয় সমতার বিষয়টি এখনও উপেক্ষিত? গার্মেন্টস এবং কৃষিখাত বাদ দিয়ে বিভিন্ন খাতে নারীকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে ‘কোটা’র  তাগাদায়। আমরা নারীর উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছি কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারী খুব বেশি নেই। তাই লিঙ্গীয় সমতার প্রসঙ্গটি আলোচনায় থাকলেও প্রতিদিনের জীবন-যাপনে আড়ালে থেকে যাচ্ছে। নারীর অংশগ্রহণই নয়, নারী সকল পর্যায়ে সমভাবে অংশগ্রহণ করছে কিনা, নিজের মতো প্রকাশ করতে পারছেন কিনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এখন আসি লৈঙ্গিক সমতাকে দেখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কী ধরনের বৈপরীত্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করছে এবং প্রশ্নহীনভাবেই চর্চিত হচ্ছে। যদি পারিবারিকভাবেই লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গীর উদাহরণ দেই  তাহলে দেখতে পাবো যে কীভাবে একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এবং অভিমতের বিষয়টি পাবলিক বিষয় হিসেবে চর্চিত হয়।

একজন নারী বয়সন্ধিকাল পার করলেই অনেকক্ষেত্রেই নারীর বিয়ে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে পরিবার। নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় পাস করলেই শুরু হয়– ‘বিয়ে হচ্ছে না কেন?’ বিয়ে হলে, ‘বাচ্চা হচ্ছে না কেন?’ বাচ্চা না থাকলে প্রশ্ন ‘বিয়ের কত বছর হইলো? সমস্যা কার? আমার পরিচিত ডাক্তার আছে’, বাচ্চা হলে ‘একটা কেন? আরেকটা নিচ্ছ না কেন?’ মেয়ে হলে ‘ছেলে নাই কেন?’ ছেলে হলে ‘মেয়ে নাই কেন?’ বাচ্চা সমাজের চোখে যোগ্য ‘মানুষ’ না হলে, ‘কী করলা, বাচ্চা মানুষ হয় নাই কেন?’ এত এত ব্যক্তিগত প্রশ্ন ‘পাবলিক’ আলাপ হিসেবে হাজির করে জর্জরিত করা হয় নারীকে।

অথচ কী অবাক বিষয় হলো এর বিপরীতে গিয়ে নারী নিপীড়ন এবং নির্যাতনকে ‘ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’র মধ্যে আবদ্ধ করা হয়। যার অর্থ হলো ঘরের মধ্যে নির্যাতন। কিন্তু এই নিপীড়ন মূলত অপরাধকে পাবলিক না করে ঘরের মধ্য নিপীড়নকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে চালিয়ে দেওয়া হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় সহনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু এটিই অপরাধ এবং পাবলিক বিষয় হিসেবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন এবং এর সুরাহা রাজনৈতিকভাবেই হওয়া প্রয়োজন।

তাহলে আমাদের প্রথম জিজ্ঞাসা নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রে পাবলিক এবং প্রাইভেটকে দেখার ক্ষেত্রে যখন ভিন্নভাবে দেখা হয়, চর্চিত হয়, তখন স্পষ্টত লিঙ্গীয় সমতার প্রশ্ন যে অনেক দূরে তা খালি চোখেই বোঝা যায়।

প্রাইমারি এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতার কাছাকাছি অবস্থান করলেও এবং ফলাফলে নারীদের সাফল্য অনেক বেশি হলেও  আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে নারীরা। এর পাশাপাশি শ্রম বাজারের কথাই যদি ধরি, তাহলে দেখতে পাবো যে, বর্তমানে ৩৮% নারী শ্রম বাজারে কাজ করছে যার বেশিরভাগই গার্মেন্টস এবং কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নারী শিক্ষার্থীদের মাত্র ৭% শ্রম বাজারে  প্রবেশ করে। শ্রম বাজারে নারীর জন্য এখনও নারী বান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে এখনও অনেক নারী শ্রম বাজার থেকে ফিরে আসছে। এর পাশাপাশি আছে নারী শ্রমিকদের ছাঁটাই। করোনার এই দুই বছরে সবচেয়ে বেশি ছাঁটাই হয়েছে নারীরা। প্রথমত যোগ্যতার মাপকাঠিতে নারীদের অযোগ্য ভাবা হয় আবার অন্যদিকে মনে করা হয় নারীর চাকরি গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু পুরুষদের চাকরি গেলে সমস্যা। তাই নারীকে খুব সহজেই চাকরিহারা করা যায়।

ঘর এবং বাজার সব জায়গায় যখন নারী এবং লিঙ্গীয় সম্পর্ক দেখার এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী তখন এবারের প্রতিপ্রাদ্য স্লোগানের বাস্তবায়ন যে আসলে অনেক দূরে রয়েছে তা বুঝতে কোনও ধরনের অসুবিধাই হয় না।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ