X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা টিকা: হরিলুটের আরেক ক্ষেত্র

রুমিন ফারহানা
১৯ এপ্রিল ২০২২, ১৬:২১আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১৬:২১
রুমিন ফারহানা ৯ জুলাই ২০২১। একটি বিজ্ঞাপন ভীষণ নজর কাড়লো সবার। এমন কোনও জাতীয় দৈনিক নেই যেখানে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছিল তখন পর্যন্ত টিকা কেনা হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ, যেখানে প্রতি ডোজের দাম ৩ হাজার টাকা। সেই হিসাবে টিকা কেনা বাবদ মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ের ঘোষণা অনুযায়ী চীন, ভারতসহ সব মিলিয়ে দেশে ক্রয় করা টিকা এসেছিল ৯০ লাখ ডোজ। বিজ্ঞাপনে কেন ১১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা বেশি কেনার তথ্য দেওয়া হয়েছে, জানা নেই। যেমন জানা নেই তথ্য প্রচারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিজ্ঞাপনের সাহায্য নেওয়া কেন।

নানা কারণে সে সময়ে বিজ্ঞাপনটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। ছিল তথ্যের ঘাটতি, ছিল অস্পষ্টতা। যে তথ্যগুলো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে খুব সহজেই সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতো, সেখানে জনগণের করের টাকা শ্রাদ্ধ করে এই বিজ্ঞাপন অনেককেই ক্ষুব্ধ করেছে। উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষকে টিকার তথ্য জানানো সে জন্য বিপুল ব্যয়ে প্রায় অর্ধপাতা জোড়া বিজ্ঞাপন কেন?

টিকার সংখ্যা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি প্রশ্ন আছে এর দাম নিয়েও। জুলাইয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের ঠিক সাত মাস আগে ২০২১ সালের জানুয়ারিতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত টিকার প্রতি ডোজের দাম ৪২৫ টাকার মতো। প্রায় কাছাকাছি তথ্য দিয়ে রয়টার্স বলে বাংলাদেশি টাকায় এই টিকার দাম ৩৪০ টাকার কম। মন্ত্রীর বক্তব্য কিংবা রয়টার্সের প্রতিবেদন যেটাই বিবেচনায় নেওয়া হোক না কেন, দেখা যাচ্ছে সেরামের প্রতি ডোজ টিকা কেনা হয়েছে ৩৪০ থেকে ৪২৫ টাকায়। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞাপনে টিকার দাম যে প্রতি ডোজ ৩ হাজার টাকা বলা হয়েছে সেটি মন্ত্রীর আগের বক্তব্যের ৭ থেকে ৯ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, জনগণের টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন ছেপে মানুষকে ভুল তথ্য দেওয়া কেন? প্রকৃত দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ দেখিয়ে মন্ত্রী আসলে কাদের রক্ষা করতে চাইছেন? দিনের শেষে এই টাকা সাধারণ মানুষের করের টাকা, সুতরাং এই টাকার হিসাব পাবার অধিকার প্রতিটা মানুষের আছে।

সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার দামের ব্যাপারে সরকারি তথ্য থাকলেও গোল বাধে চীন থেকে কেনা সিনোফার্ম টিকার দাম নিয়ে। সরকার এই ব্যাপারে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের ধোঁয়া তুলে শুরুতেই এই ব্যাপারে তথ্য দিতে অনিচ্ছুক ছিল। যদিও চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের পর মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব সাংবাদিকদের জানান, টিকার প্রতি ডোজ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৪০ টাকায় কেনা হচ্ছে। সম্ভবত এই তথ্য জানানোর অপরাধেই তাকে ওএসডি করা হয়। পরবর্তী সময়ে আর এই বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কোনও কর্মকর্তাই মুখ খোলেননি।

এরপর পানি গড়িয়েছে বহুদূর। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে টিকার অদ্ভুত দাম জানানো হলেও টিকা কিনতে ঠিক কত টাকা ব্যয় হয়েছে, সেই বিষয়ে বারবার প্রশ্ন করা হলেও সংসদে মুখ খোলেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক। তার ভাষ্যমতে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে টিকা কেনায় সংসদে অর্থ খরচের হিসাব প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। তবে তিনি বারবারই বলেন সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সততা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে টিকা কেনা হয়েছে। সততা ও স্বচ্ছতার বিষয় কিছুটা আপেক্ষিক বলে এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলতে পারে, তাই আপাত আলোচনায় এ দুটো সরিয়ে রেখে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে কেনার বিষয়টি আলোচনা করি।

গত ১১ এপ্রিল এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে টিকা কেনা ও ব্যবস্থাপনায় বেশি খরচ করেছে বাংলাদেশ। রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশ প্রতি ডোজ টিকা কিনছে দেড় হাজার টাকার বেশি দামে, যেখানে নেপালে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়ছে ৩৬২ টাকা।

সম্প্রতি টিকা নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সরকারিভাবে ক্রয় করা হয়েছে প্রায় ৯.২ কোটি ডোজ, কোভ্যাক্স কস্ট শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ৮.৭ কোটি ডোজ এবং বিভিন্ন দেশের সরকার ও কোভ্যাক্স থেকে অনুদানের মাধ্যমে প্রায় ১১.৭ কোটি ডোজ টিকা বিনামূল্যে পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে কোভিশিল্ড প্রতিডোজ ৫ ডলার (৪২৫ টাকা), সিনোফার্ম ১০ ডলার (৮৫০ টাকা) এবং কোভ্যাক্স কস্ট শেয়ারিং ৫.৫ ডলার (৪৬৭.৫ টাকা) হিসাবে ধরে আনুমানিক টিকার খরচ দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৫৪.৪ কোটি টাকা। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে তাঁর বক্তব্যে কোভিড-১৯ টিকা ক্রয়ে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে উল্লেখ করেন।

এর ঠিক এক মাস পর ১০ মার্চ গণমাধ্যমে টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সরকারি তথ্যমতে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৪.৩৬ কোটি ডোজ টিকা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের টিকা পরিকল্পনায় টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয় টিকা প্রতি দুই ডলার (১৭০ টাকা) হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া কোভ্যাক্স রেডিনেস অ্যান্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয়ের মডেল করা হয়। যেখানে একটি দেশের টিকা কার্যক্রমে বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল ব্যবহার এবং আউটরিচ কেন্দ্রের অনুপাত বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের পর থেকে মানুষকে টিকা দেওয়া পর্যন্ত সব ব্যয় হিসাব করে টিকাপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ০.৮৪ ডলার (৭১.৪ টাকা) থেকে ০২.৬৪ ডলার (২২৪.৪ টাকা)। সেই হিসাবে টিকা কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রাক্কলিত পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৯.৬ কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার ৪৬৭.৩ কোটি টাকার মধ্যে। উল্লিখিত টিকার প্রাক্কলিত ক্রয়মূল্য ও টিকা ব্যবস্থাপনার প্রাক্কলিত মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রদত্ত হিসাবের অর্ধেকেরও কম। যদি ধরেও নিই টিকা কেনা এবং এর ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়েছে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, তারপরও হিসাবের গরমিল থাকে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। মজার ব্যাপার হলো, কেবল একটি দেশের টিকার ক্ষেত্রে টিকার ক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকলেও অন্যান্য উৎস থেকে কেনা টিকার ব্যয় এবং টিকা কার্যক্রমে কোন কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তাও প্রকাশ করা হয়নি।

অস্বচ্ছতায় ঢাকা পুরো প্রক্রিয়ায় এই টাকা কাদের হাতে কি করে গেলো সেই ব্যাপারে তদন্ত হবে কি? মন্ত্রী কি জবাব দেবেন নাকি সবটাই ঢাকা পড়ে যাবে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের ছায়ায়? কিংবা কে জানে করোনার শুরু থেকে মাস্ক, পিপিআরসি, করোনার রিপোর্টসহ সব ক্ষেত্রে যে হরিলুট আর অব্যবস্থাপনা দেখে এসেছি, এটি হয়তো তার ধারাবাহিকতা ছিল মাত্র।  


লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ