X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির ইন্ধন ও আয়তন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৮আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:০৮
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সম্প্রতি একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বিশ্বে দ্রুত ধনী হওয়ার হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। অথচ ধনী লোকদের মধ্যে কর প্রদানের প্রবণতা কম, ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। দেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বাড়লেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটি স্বীকার করছেন না। যেকোনও সমস্যা অস্বীকার করলে তার সমাধান সহজ হয় না’।

দেশে যে দ্রুত কিছু লোক ধনী হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় নানাভাবে। বাংলাদেশের একদম প্রান্তিক পর্যায়েও এখন যত প্রকার দামি গাড়ি চোখে পড়ে সেটা আমাদের আশপাশের অনেক দেশে এভাবে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের মতো একটা গরিব (মতান্তরে উন্নয়নশীল) দেশে যতজন মহা-ধনী থাকা প্রত্যাশিত, বাস্তবে তেমন বড়লোকের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। কালো টাকার কথা ভাবলে সেটা নিশ্চয়ই আরও বেশি। জনসংখ্যার নিরিখে ধনীর সংখ্যা অন্য দেশের থেকে বেশি বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের কথায়। এ কথা তো সত্যি যে অনেক বেশি দরিদ্র মানুষও বাস করে বাংলাদেশে। তাই দ্রুত ধনী হতে পারার এই তত্ত্বে আমরা আনন্দিত হবো, নাকি চরম আর্থিক বৈষম্যের প্রতিফলন ভেবে উদ্বিগ্ন হবো, সেটা ভাবনার বিষয়।

এ কথা সত্যি যে দেশে অতি-ধনীর সংখ্যাটা বেশ বড় হচ্ছে এবং এদের বড় অংশটাই হঠাৎ ধনী হচ্ছে নানা ফন্দি ফিকির করে, বিশেষ করে রাজনীতি আর আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থেকে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। অর্থনীতির যে অংশটি কালো টাকায় চলে, যাকে ছায়া-অর্থনীতি বলা হয়, সেটা আরও বড়, যার পরিমাণটা সেভাবে প্রকাশিত নয়। আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যত, দেশের কালো অর্থনীতির মাপ তার প্রায় দ্বিগুণ। ফলে, বাংলাদেশে অতি-ধনীদের আসল সংখ্যা আমাদের চিন্তার দিগন্তের বাইরে।

স্বভাবতই দুর্নীতির প্রসঙ্গটি আসে। কিন্তু এই দুর্নীতি কথাটার মধ্যে অনেক ধোঁয়াশা আছে। কারণ হলো, দেশে কী অনেক বেশি লোক ঘুষ নেয়? নাকি যদি অনেক বেশি টাকা ঘুষ দিতে হয়? আসলে দুটোই। ছোট কোনও কাজের জন্য একদম প্রান্তিক পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মী যেমন ঘুষ খায়, তেমনি বড় কাজের পার্সেনটেজের আকারটাও দৈত্যের মতো। অনেকেই বলতে চান, দুর্নীতি আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, তবে এখন নানা মাধ্যমের সক্রিয়তায় প্রকাশিত হচ্ছে বেশি। তাই বেশি চোখে পড়া মানেই দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া, এমনটা বলা তাই সহজ নয়। এ বক্তব্য তর্ক সাপেক্ষ। আগে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে টাকা গুজে দেওয়ার দৃশ্য বড় মনে হতো, এখন এগুলো গা সয়ে গেছে সবার।

আলোচনাটা হওয়া দরকার দুর্নীতি হয় কেন? বা কেন হতে পারে তা নিয়ে। শাসন ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকলে অনিয়ম, অদক্ষতার পাশাপাশি দুর্নীতির বিকাশ ঘটে। সাধারণ মানুষ তার ন্যায্য পাওনাটুকু পেতেও ঘুষ দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। এমনকি সরকারকে বিভিন্ন ফিস, কর বা বিল দিতে গিয়েও ঘুষ দিতে হয়। ক্ষমতা কিংবা অর্থ– এ দুটোর একটি না থাকলে কোনও সরকারি অফিসেই সে অর্থে কোনও কাজ বেশিরভাগ মানুষ সেরে আসতে পারে না। আরেকটা হলো আইন ভাঙার প্রবণতা। আমাদের দেশে মানুষ ঘুষ দেয় যাতে সুবিধা মতো আইন ভাঙতে পারে। আর সেই সুযোগটা নিতে বিলম্ব করে না সরকারি কর্মী বা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আমলারা আইনের খসড়া রাজনীতিবিদদের হাতে এমনভাবে তৈরি করে দেন যেন, তার সব অবৈধ আয়ের পথটার একটা বৈধতা থাকে।

দুর্নীতি মানে শুধু ঘুষ নয়, টাকা নয়ছয় নয়। সময়ের অপচয়ও একটা পরিমাপ। অদক্ষতা একটি সূচক। সরকারি কর্মীরা যদি গরহাজির থাকেন, যদি অকারণে কাউকে বহু দিন ঘোরান এবং কোনও কাজ করার যদি সক্ষমতা না থাকে, তবে সেটিও দুর্নীতি। বাজার অর্থনীতির এই সমাজে লুটপাটটা যেমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছে, অদক্ষতাও সীমা ছাড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর বাজার অব্যবস্থাপনায়, ঈদের ট্রেন, বাস, লঞ্চ পরিবহন ব্যবস্থাপনায়, উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণে অতিরিক্ত খরচ আর মাত্রাতিরিক্ত সময় ক্ষেপণে এখন এগুলো উন্মোচিত।

দুর্নীতির ইন্ধন ও আয়তন, দুই-ই আজ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। অর্থনীতির বৃদ্ধি যত ঘটছে, ততই নেতা-আমলাদের সামনে প্রলোভন বাড়ছে। যারা জমির দাম, বিদ্যুতের দাম বা মোবাইল ফোনের কথা বলার দাম ঠিক করার বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তারা প্রথমেই নিজের দফতরকে ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার কাজটা করেন। ফলে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তেমনি, দারিদ্র দূরীকরণ বা উন্নয়নের নানা প্রকল্পে আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা আসছে, তাই বেশি দুর্নীতি হচ্ছে এবং দ্রুত ধনী মানুষ সৃষ্টি হচ্ছে। নির্বাচনি খরচ অনেক বেড়েছে। ভোট ঠিকমতো না হলেও নমিনেশন পাওয়ার বিনিয়োগ অনেক বেশি হয়ে গেছে। কোনও কিছুই বৈধ উপায়ে জোগাড় করার উপায় নেই। তাই রাজনীতিতে দুর্নীতি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বিচারব্যবস্থার দশাও ভালো না। মামলার পাহাড় জমে যাওয়ায় কোনও অভিযোগের ফয়সালা সহজে হয় না। ফলে বিচার বিভাগে আগের চেয়ে বেশি অর্থের আনাগোনার পথ তৈরি হয়েছে। সরকারি কর্মীদের মাইনে বেড়েছে, সেই সঙ্গে ঘুষের অঙ্কটাও বড় হয়েছে। এখানে ঐক্যটা খুব সুশৃঙ্খল। প্রশাসনের পদ্ধতি এমনই যে বহু লোক মিলে একটি ফাইল আটকে দেয়, আর ছেড়ে দেওয়ার কথা হয়তো ভাবে দু-একজন। যেসব সৎ ও সাহসী সরকারি কর্মকর্তা কাজে গতি আনতে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, নতুন ধরনের কাজে উদ্যোগী হন, তাঁদের বিপন্ন করা হয়, যেমন করে বিপন্ন হতে হতে নিশ্চিহ্ন আজ মানুষের নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ।

লেখক: সাংবাদিক  
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ