X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইসি কেন ইভিএম চায়?

আমীন আল রশীদ
২৭ আগস্ট ২০২২, ১৯:০৯আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২২, ১৯:০৯

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারকে সমর্থন করলেও ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের অধিকাংশই এর বিরোধিতা করেছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ দেড়শো আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।

নির্বাচনের প্রধান স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলসমূহ। কোন পদ্ধতিতে ভোট নেওয়া হবে—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের থাকলেও যে পদ্ধতি বা মেশিন নিয়ে অধিকাংশ দলের অনাস্থা ও সংশয় রয়েছে—নৈতিকভাবে ইসি সেই পদ্ধতিতে ভোট নিতে পারে কিনা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর মতামতকে উপেক্ষা করার অধিকার তাদের রয়েছে কিনা—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

কেন ইভিএম? একটু পেছনে তাকানো যাক।

দেশে ইভিএমে সর্বপ্রথম ভোট নেওয়া হয় ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে এবং সেখানে এই মেশিনের সাফল্য সবাইকে অভিভূত করে মূলত এর দ্রুতগতির গণনায়। ভোট গ্রহণের মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় এবং ওই মেশিনে কারচুপি হয়েছে—এমন অভিযোগও ওঠেনি।

বড় পরিসরে এই মেশিনে প্রথম ভোট নেওয়া হয় ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি কেন্দ্রে। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়। ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। জটিলতার কারণে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। এরপর যতবারই ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, কমবেশি বিতর্ক হয়েছে।

এই মেশিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা দ্রুত ভোট গণনা। আর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, অধিকাংশ মানুষ এই মেশিনে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত নয়। ফলে ভোট গ্রহণ হয় ধীর গতিতে। অনেক সময় বৃদ্ধ ও কম পড়ালেখা জানা কিংবা পড়ালেখা না জানা মানুষ ঠিকমতো এই মেশিনে ভোট দিতে পারেন না বলে বুথের ভেতরে কেউ কেউ তথাকথিত সহায়তার নামে নির্দিষ্ট কোনও প্রার্থীর মার্কায় টিপ দিতে বাধ্য করেছেন—এমন অভিযোগও অনেক। এসব কারণে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।

সবশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারও ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ আনেন। তিনি ইভিএমকে ‘জালিয়াতির বাক্স’ বলে মন্তব্য করেন এবং দাবি করেন পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাকে পরাজিত করেছে।

এরকম বাস্তবতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসি যে সংলাপ করেছে, সেখানে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো প্রধানত দুটি বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে; ১. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং ২. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকারের নামে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই এবং তারা তিনশো আসনেই ইভিএম-এর পক্ষে।

মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ দেড়শো আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায়। পরদিন বুধবার বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সংলাপে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকলেও তাদের বক্তব্য মুখ্য বিবেচনায় আসেনি। আমরা নিজেরাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভোট সুষ্ঠুভাবে করতে ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইভিএমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনকালীন সময়ের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এবং ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরীক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জেএসডি) ইভিএম নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। আর বিএনপি ও তাদের মিত্ররা কমিশনের সংলাপে অংশ না নিলেও দীর্ঘদিন ধরেই তারা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু গত ৭ মে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৩০০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। নির্বাচনের কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেন, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের সবগুলোতেই তারা ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তার মানে এটি স্পষ্ট যে, সকল রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে থাকলেও ক্ষমতাসীন দল যেহেতু তিনশো আসনেই ইভিএম চায়, ফলে এটি ইসির ওপরে একধরনের চাপ তৈরি করেছে।

সিইসির ভাষায়, ‘ভোট সামলাবে ইসি, রাজনৈতিক দল নয়। ইসির এটা বড় দায়িত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। ভোট যেন আরও স্বাচ্ছন্দ্য, আরও সুষ্ঠু হতে পারে, তা নিশ্চিত করবে ইসি। যারা ভোট দিতে আসবেন, সেটা আমাদের মুখ্য বিবেচনায় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো কে কী বলেছে, সেটা আমাদের মুখ্য বিবেচনায় আসেনি।’ ইভিএম নিয়ে যেসব সংশয় রয়েছে বা এই যন্ত্রের মাধ্যমে কোনও কারচুপি করা হয়েছে কিনা, তা ভোটের পরে বোঝা যাবে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি।  

প্রশ্ন হলো, ভোটের পরে যদি বোঝা যায় যে কারচুপি হয়েছে, তখন ইসি কী করবে? ভোট বাতিল করে পুনরায় ব্যালট পেপারে ভোট নেবে? অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, ভোটের কারচুপির অভিযোগ আনা হলেও এবং নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা হলেও তা নিষ্পত্তি হতে হতে পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসে। সুতরাং ইভিএমে ভোট নেওয়ার পরে যদি বিরাট সংখ্যক আসন থেকে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তাহলে কারচুপি বা জালিয়াতি হয়েছে কি না, তা প্রমাণ করতে করতে এবং প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সময় চলে আসবে।

মুশকিল হলো, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, আগের রাতে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্সে ভরে রাখার মতো পরিস্থিতি এড়ানো এবং দ্রুত ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণার সুবিধার কথা মাথায় রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হলেও যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা—সেই পরিস্থিতির কোনও অবসান হয়নি। হয়নি বলেই ইভিএমও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি।

যদিও নির্বাচন কমিশনের দাবি, ইভিএমে কোনও ধরনের কারচুপি বা জালিয়াতির সুযোগ নেই এবং তারা মেশিনের ত্রুটি ধরার জন্য চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছিল। সে কারণে তর্কের খাতিরে যদি এটি ধরেও নেওয়া যায় যে, ইভিএমে কোনও ত্রুটি নেই বা এর মাধ্যমে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়, তারপরও নির্বাচনের প্রধান অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশই যদি এই মেশিনের বিপক্ষে থাকে; যদি এই মেশিনটি সব প্রার্থীর আস্থা অর্জন করতে না পারে এবং প্রার্থীদের মধ্যে যদি এই ধারণা থেকেই যায় যে, ইভিএমএ কারচুপি করা যায়, তাহলে ভোট যত শান্তিপূর্ণই হোক না কেন, আখেরে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

ভোট যত শান্তিপূর্ণ হোক, ভোটার উপস্থিতি যতই হোক কিংবা ভোট যত অংশগ্রহণমূলক এবং উৎসবমুখরই হোক না কেন, যে মেশিনে মানুষ ভোট দেবে, সেই মেশিনটি যদি সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে সেই ভোটও বিশ্বাসযোগ্য হয় না। এখনও বিরাট সংখ্যক মানুষ ইভিএমে ভোট দিয়ে আসার পরে সংশয়ে থাকেন তিনি যে তরমুজ মার্কায় ভোট দিলেন, সেটি তরমুজ মার্কায় পড়েছে নাকি কলা মার্কায়? এই অবিশ্বাস, এই সংশয় ভোটারদের মধ্যেই আছে। অথচ ভোটারদের এই অনাস্থা, অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করা এবং সহজে ও দ্রুততম সময়ে এই মেশিনে ভোট দেওয়ার বিষয়ে খুব বড় পরিসরে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেয়নি। নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের মধ্যে এই মেশিনটি নিয়ে খুব বেশি প্রচার হয় না বা বড় পরিসরে হাতে-কলমে এর ব্যবহারও শেখানো হয় না।

সুতরাং মেশিন হিসেবে ইভিএম যত আধুনিক এবং সুরক্ষিত হোক না কেন—যদি নির্বাচনে অংগ্রহণকারী সব দল এই মেশিনে আস্থাশীল না হয় এবং নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য তৈরি না হয়, তাহলে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার মানে হয় না।

সর্বোপরি, আগামী সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতগুলো আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে এখনই উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। কারণ রাজনীতিতে শেষ বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি আগামী নির্বাচনের আগে যেহেতু আরও প্রায় এক বছর চার মাস বাকি আছে, ফলে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কী কী পরিস্থিতি তৈরি হয়; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার জোট এই ইস্যুতে কী ধরনের জনদাবি সামনে এনে সরকার ও ইসিকে কতগুলো দাবি মানাতে পারবে—তারউপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। তবে এটা ঠিক, নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি ও তার শরিক বা সমমনা দলগুলোর প্রধান দাবি যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, তার সঙ্গে এবার এই ইভিএমেএ ভোট না দেয়ার দাবিটিও যুক্ত হবে এবং আগামী দিনগুলোয় তারা এই ইস্যুতেও ‘জ্বালাময়ী’ বক্তব্য দেবেন।   

যদিও এই ইস্যুতে কোনও সংকট হবে কিনা—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতটা আমরা বলতে পারবো না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আগের নির্বাচনগুলো নিয়েও আপনারা সংকটের কথা বলেছেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে সংকট হবে কিনা, তা প্রিডিক্ট করার সাধ্য নেই।’

সিইসির এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে হয়, কী করলে কী হয় বা হতে পারে; বিশেষ করে কী ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে—সেটি প্রিডিক্ট বা ধারণা করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকতে হয়।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ