X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকের মতো অন্য খাতও কেন বদলায় না?

আমীন আল রশীদ
১৯ নভেম্বর ২০২২, ১৬:০৫আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ১৬:০৫

‘বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পোশাক কারখানা বাংলাদেশে।’ গত ৯ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউনের এই সংবাদটি দেখে যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, দলমতনির্বিশেষে নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকেই খুশি হয়েছেন। কিন্তু এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ২২ অক্টোবর প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম: ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ৬০ ভাগ বস্ত্রকল ঝুঁকিতে।’

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়, গত মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস–সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে করে কারখানাগুলো উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফলে যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরে দেশের বদলে যাওয়া বা আমূল পাল্টে যাওয়া পোশাক কারখানায় কি তবে এখন শঙ্কার পদধ্বনি? এরকম প্রশ্নের মধ্যেই গত ১৩ নভেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো শুরু হয় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ সপ্তাহ’। এতে বিভিন্ন দেশ, কোম্পানি ও ব্র্যান্ডের ৭০০ প্রতিনিধি অংশ নেন।

এর পরদিন রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের (আইএএফ) আয়োজনে ৩৭তম আইএএফ বিশ্ব ফ্যাশন সম্মেলনে বক্তারা বলেন, পরিবেশের সুরক্ষায় ইউরোপসহ বিশ্বের প্রধান ক্রেতাদেশগুলো টেকসই পোশাকে জোর দিচ্ছে। এজন্য পণ্য উৎপাদকের পাশাপাশি সরবরাহকারী ও ভোক্তা পর্যায়ের সবাইকে নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন ইউরোপের পোশাক খাতের নীতিনির্ধারকেরা।

তারা বলছেন, পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত না করলে বাংলাদেশের পক্ষে ইউরোপের বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

তার মানে শুধু উৎপাদনের প্রধান শর্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই নয়, বরং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিও বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। যদিও পরিবেশের ইস্যুটি যে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছে, তার প্রমাণ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবুজ পোশাক কারখানার দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) সর্বশেষ প্রকাশনায় এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আইটিসি বলছে, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক উৎপাদনের নিরাপদ কর্মপরিবেশ হিসেবে অনেক ভালো অনুশীলন আছে বাংলাদেশে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৪ জন। আহত হন ২ হাজারের বেশি। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১৭ জনের প্রাণহানি এবং ৩ শতাধিক শ্রমিক আহত রেশ না কাটতেই এ ঘটনার পাঁচ মাসের মধ্যে ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজায় এই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ে দেশের প্রধান রফতানি আয়ের খাত পোশাক শিল্প। বিদেশের বাজারেও আস্থার সংকটে পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প। তবে দ্রুতই পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। নানামুখী উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে পোশাক খাত। বিশেষ করে গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানায় প্রচুর বিনিয়োগ আসতে থাকে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শুরু হয় সুস্থ প্রতিযোগিতা। একে একে গড়ে উঠতে থাকে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি।

এই বিরাট পরিবর্তনের পেছনে প্রধানত ভূমিকা রেখেছে বিদেশি ক্রেতাদের চাপ। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্স না মানলে বিদেশি ক্রেতারা পোশাক কিনবেন না—এই ভয়ের কারণেই পোশাক কারখানাগুলোর মালিকরা উদ্যোগী হয়েছেন। বাস্তবতা হলো, শুধু নীতিকথা দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করা কঠিন। পরকালের শান্তির বাণী ও শাস্তির ভয়ও অনেক সময় কাজে আসে না। আসে না বলেই দুর্নীতি এখনও বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। কিন্তু সেই দেশই গ্রিন কারখানায় বিশ্বের শীর্ষে। তার মানে এখানে দেশপ্রেম বা ব্যবসায়ের সততা যতটা কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ব্যবসা হারানোর ভয়। এই ভয়টা অন্যান্য খাতে নেই বলে; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ বলে এখনও উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে, সুশাসন নিশ্চিত করার পথে প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি।

তৈরি পোশাক খাত যে দুটি বড় দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, সেজন্য এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দেশে এখন সবুজ পোশাক কারখানার সংখ্যা ১৭৩টি। এর মধ্যে ৫৪টি কারখানা প্লাটিনাম রেটিং, ১০৫টি গোল্ড রেটিং ও ১০টি সিলভার রেটিং পেয়েছে; যা বিশ্বের যেকোনও দেশের চেয়ে বেশি। দীর্ঘদিন ধরে এই শীর্ষস্থান দখল করে আছে বাংলাদেশ।

এছাড়া বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার মধ্যে ৯টির মালিক বাংলাদেশ—যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন এবং সারা বিশ্বে মেইড ইন বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত ও নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে না পারলে এই অর্জন যে ম্লান হয়ে যাবে, এরইমধ্যে সেটির ইঙ্গিত দিয়েছেন পোশাক খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়ে আড়াই ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। তাছাড়া কাপড় রং করার ডাইং কারখানাগুলোও লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে রফতানি আয় বাড়লেও কমেছে প্রবাসী আয়। এতে দেখা দিয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। ফলে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। যাতে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বিশেষ করে ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে গিয়ে জটিলতায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। ইউরোপ ও আমেরিকায়ও রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। সে কারণেও পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার সবশেষ (২০২২) হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ এসেছে পোশাক খাত থেকে। করোনাভাইরাসের অতিমারির কালে অনেক অর্ডার বা ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার কারণে এই খাত নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, সেটিও কেটে গেছে। দ্রুতই বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো ফিরে আসতে থাকে। ফলে করোনার মধ্যেও চমক দেখিয়েছে পোশাক খাত।

২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠর শিরোনাম: ‘পোশাক খাতের রফতানি আয়ে চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ।’ খবরে বলা হয়, কয়েক মাস ধরে তৈরি পোশাক শিল্পে ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর আগস্টে এসে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে নিট পোশাকে।

এইসব সংবাদে আশাবাদী হওয়ার সাথে সাথে আমাদের এখন যে প্রশ্নটি সামনে আনা দরকার তা হলো, পোশাক খাতের মতো অন্য খাতগুলোয়ও কেন পরিবর্তন হচ্ছে না? কেন দুর্নীতি এখনও আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে? তার মানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে?

পোশাক খাতের কারণে সারা বিশ্বে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বাক্যটি যেখানে জনপ্রিয় হয়েছে, সেখানে সুশাসন ও জবাবদিহির ইস্যুতে সেই দেশটি বহির্বিশ্বে দুর্নামের ভাগিদার হবে, সেটি কারোরই কাম্য নয়। ফলে দুটি বড় দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যেভাবে দেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে, সেভাবেই দেশের অন্য সকল প্রতিষ্ঠান বদলে যাবে; দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হবে; বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে—এটিই প্রত্যাশা। এর জন্য প্রধানত দরকার পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইশতেহার তৈরি করবে, সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান এবং কর্মপরিকল্পনা থাকবে এবং সরকার গঠনের পরে সেই পরিকল্পনামাফিক দেশকে এগিয়ে নেবে—এ মুহূর্তে এটিই সবচেয়ে বড় চাওয়া।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ