X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের কোর্স কি চালু হবে?

শ্যামল আতিক
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:১৪আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:১৪

এমন একটি সময়ে আমরা বাস করছি, যেখানে শিক্ষার্থীদের জীবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট শিশু-কিশোরদের সুস্থ বিকাশের জন্যে মোটেই অনুকূল নয়। পরীক্ষায় ব্যর্থতা, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা, ভার্চুয়াল আসক্তি, ইভটিজিং, বুলিং– ইত্যাদি কারণে যে মানসিক চাপ তৈরি হয় সেটা প্রশমনের জায়গা কোথায়? খেলাধুলার জায়গা নেই, নেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নেই কোনও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ– তাহলে ছাত্রছাত্রীরা কী করবে?

ফলাফল হচ্ছে– পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, বখে যাওয়া, নৈতিক অধঃপতন, মাদকে আসক্ত হওয়া, সহিংসতা, কিশোর গ্যাংসহ নানা ধরনের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া। আরেকটি অংশ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। সামাজিক সংগঠন আচল ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে– কোভিড সংক্রমণের প্রথম ১২ মাসে (মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) দেশে আত্মহত্যা করেছে সাড়ে ১৪ হাজার, যার বেশিরভাগ কিশোর ও তরুণ। ২০২১ সালে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালে সারা দেশে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই (৪৪৬ জন) স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, কোভিডকালে তা ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, লকডাউনের কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মোবাইল ইন্টারনেট আসক্তি, কায়িক পরিশ্রম না করা, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা– ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছে।

এর বাইরেও কারণ আছে। আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইমপালসিভ বা ঝোঁকের বশে অথবা অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফলাফল। পরিবারের কেউ বকাঝকা বা তিরস্কার করলে, পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, বিশেষ লক্ষ্য বা স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়ে, প্রেমে ব্যর্থতা বা সম্পর্কে টানাপোড়েন হলে অভিমান বা আবেগের বশবর্তী হয়ে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকেই তারা মুক্তির উপায় মনে করে।  

বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেবা চালু করার কথা বলেছেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সীমিত জনবল, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও বাজেট দিয়ে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলক চালু করা যেতে পারে। তবে এটাই পর্যাপ্ত নয়। পাশ্চাত্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সুবিধা থাকার পরও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। এ ধরনের সেবার একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে– অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা স্কুল কর্তৃপক্ষ বা কাউন্সেলর জানতেই পারেন না। কারণ, শিক্ষার্থীরা কখনও মুখ ফোটে কিছু বলেনি অথবা তাদের আচরণে হতাশার বিষয়টি ধরা পড়েনি।  

তাই এমন কিছু করা চাই– যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট রাখবে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে– যাতে তারা নিজেরাই যেকোনও প্রতিকূলতা মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন করে। এখানেই ইতিবাচক জীবদৃষ্টি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানোর প্রাসঙ্গিকতা এসে যায়।

উন্নত দেশের শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানো হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে শিশুরা তাদের আবেগ চিহ্নিত করতে বা বুঝতে (verbalize) পারে, আবেগের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। তাই শিশুকে ধরিয়ে দিতে হবে– কোনটা রাগ, কোনটা ঈর্ষা, কোনটা বিরক্ত, কোনটা আনন্দ, কোনটা হতাশা, কোনটা ভয়, কোনটা দুঃখ? শিশুর প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এই আবেগগুলো ধরিয়ে দিতে হবে। কাজটিকে সহজ করার জন্যে প্রয়োজনে শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে, দিল্লির আম আদমি সরকার ব্যতিক্রমী এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দিল্লি সরকার ২০১৮ সালে তাদের স্কুল কারিকুলামে ‘হ্যাপিনেস’ নামে নতুন কোর্স চালু করেছেন। এই হ্যাপিনেস কোর্সের অধীনে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ৪৫ মিনিটের একটি ক্লাস করবে, যেখানে ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম শেখানো হবে। ২০২০ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারও কোভিডকালীন ক্ষতি পোষাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম চর্চার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

আসলে আবেগ নিয়ন্ত্রণে ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামের কার্যকারিতা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। সারা পৃথিবীতে এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে– ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম করলে পড়াশোনায় মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়ে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, চালচলনে স্থিরতা আসে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ে, ধৈর্যশক্তি বাড়ে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। নিয়মিত মেডিটেশনে হতাশা দূর হয়, মানসিক চাপ প্রশমিত হয়, আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস পায়। ধ্যান ও যোগ ব্যায়ামের যুগপৎ চর্চা দেহ মনে ঐকতান সৃষ্টি করে, হরমোন গ্রন্থিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনে, দেহ-মনে আনন্দের অনুরণন সৃষ্টি করে।
 

বসে নেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অক্সফোর্ড, হার্ভাড, স্ট্যানফোর্ডসহ বিশ্বের বনেদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (Wellbeing, Mindfulness, Positive Psychology নামে) নানা ধরনের কোর্স চালু করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে- শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচকতা ও সমমর্মিতা সঞ্চারিত করা, হতাশা ও বিষণ্নতা থেকে মুক্ত করা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, পড়াশোনায় সাফল্য, মনোযোগ বৃদ্ধি এবং মনোদৈহিক সুস্থতা। এসব কোর্সে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের পাশাপাশি মেডিটেশন, দমচর্চা এবং যোগ ব্যায়ামের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানো হয়।  

সারা পৃথিবী যখন ছাত্রছাত্রীদের রক্ষার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে, তখন আমরা কী করছি? আর কত শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলে নীতিনির্ধারকদের টনক নড়বে– তা আমাদের জানা নেই। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা এই বিষয়টিতে বিশেষ মনোযোগ দেবেন। ক্রমবর্ধমান এই কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য হলেও আত্মনিয়ন্ত্রণের এসব কোর্স চালু করুন।    

লেখক: প্যারেন্টিং গবেষক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ