X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

ভূমিহীনদের ফাঁসিয়ে ঋণ তুলে ফেরারি আ.লীগের দুই নেতা!

বিজয় রায় খোকা, কিশোরগঞ্জ
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১০:১৫আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:৪৫

সোনালী ব্যাংকের তাড়াইল শাখা ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়েও ঋণের জালে আটকে গেছেন কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের ৪১ জন ভূমিহীন কৃষক। সোনালী ব্যাংকের তাড়াইল শাখা থেকে তদের নামে একটি প্রতারকচক্র প্রায় ১০লাখ টাকা কৃষিঋণ তুলে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি অনুদানের লোভ দেখিয়ে ওইসব প্রান্তিক কৃষকের স্বাক্ষর ও ছবি নিয়ে এ প্রতরণা করা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের স্থানীয়  দুই নেতা এ অপকর্ম করে এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন। এই দুই নেতা হলেন- তাড়াইলের ধলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক ও সাবেক প্রচার সম্পাদক তনু মিয়া।  

অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সোনালী ব্যাংক কিশোরগঞ্জ প্রিন্সিপাল শাখার এজিএম মো. মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতারণা করে ঋণ তুলে আত্মসাৎ

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ছোট একটি বসতবাড়ি ছাড়া বাকপ্রতিবন্ধী খেলন মিয়ার সহায়সম্পদ বলতে আর কিছু নেই। সেখানেই তিনি তার মাকে নিয়ে বসবাস করেন। মানুষের ফুটফরমাশ খাটেন, দিনমজুরি করেন। এভাবেই  চলে যাচ্ছিল মা-ছেলের সংসার। তিনিও আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সরকারি অনুদান পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তার নামে সোনালী ব্যাংক, তাড়াইল শাখা থেকে ২০ হাজার টাকা কৃষিঋণ উঠিয়ে নিয়েছেন তারা। ঋণের টাকা থেকে তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯০০ টাকা। এখন ব্যাংক বলছে, খেলনকেই পরিশোধ করতে হবে ঋণের পুরো টাকা।

খেলনের চাচাতো ভাই আজিজুল হক বলেন, ‘আমার ভাই কথা বলতে পারেন না । তনু মিয়া ও আবদুল হক তাকে ইশারায় বোঝায় যে সরকার থেকে কিছু ভাতা এসেছে। তাদের সঙ্গে ব্যাংকে গেলে এক হাজার টাকা পাবে । এই বলে তনু মিয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ ব্যাংকের নিচে খেলনকে বসিয়ে কিছুক্ষণ পর একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে ৯’শ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়।’ খেলন

তিনি বলেন, ‘ আমরা কয়েকদিন পর জানতে পারি, আমার ভাইয়ের নামে ২০ হাজার টাকা কৃষিঋণ উঠিয়ে নিয়েছেন তারা। আমরা খুব গরিব। নিজেদের থাকার মতো জায়গাই নেই। এ টাকা আমরা কেমনে পরিশোধ করবো।’

অন্যের দেওয়া একখণ্ড জমিতে ঘর তুলে বাবা-মা ভাইবোনদের নিয়ে থাকেন আবু বকর সিদ্দিক। প্রলোভনে পড়ে তিনিও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও ছবি তুলে দেন ওই দুই আওয়ামী লীগ নেতার হাতে। স্বাক্ষরও দেন তাদের দেওয়া কাগজপত্রে। সেদিন ৬০০ টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। দেড়মাস পর তিনিও জানতে পারেন, তিনি নাকি ব্যাংক থেকে ২৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন।

আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা অন্যের জমিতে থাকি। আমারে মিছা কথা কইয়া তনু মিয়া এমুন কাম করছে। অহন আমি কী করবাম কিছুই বুঝতাছি না। আমারে হে কইছিল মাসে মাসে ছয়শ টেহা ভাতা পাইয়াম।’

খেলন ও আবু বকরের মতো তাড়াইলের ধলা ইউনিয়নের উত্তরধলা ও তেউরিয়া গ্রামের আরও ৩৯ জনের সঙ্গে প্রতরণা করে, জমিজমার ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে সোনালী ব্যাংকের তাড়াইল শাখা থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা কৃষিঋণ তুলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওই দুই নেতা। প্রতারিত ভূমিহীনরা

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ধলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক ও সাবেক প্রচার সম্পাদক তনু মিয়া ব্যাংকের লোকজনের সহযোগিতায় গত তিন মাসে ৪১ জনের নাম ব্যবহার করে ঋণ উঠিয়ে পালিয়ে গেছেন। এ প্রতারণায় ব্যাংকের লোকজনও জড়িত রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, সরেজমিন তদন্ত করে ঋণ মঞ্জুর বা না-মঞ্জুর করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিয়মটি মানা হয়নি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আহাদিন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ভাতা দিলে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা দেবেন। কিন্তু এই গরিব অসহায় মানুষদের মিথ্যা বলে লাখ লাখ টাকা ওরা উঠিয়ে নিয়েছে। আমি বিষয়টি জানার পর ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ম্যানেজার আমাকে বলেছেন, ‘এগুলো কোনও ভাতা না কৃষিঋণ। এই টাকা পরিশোধ করার মতো ক্ষমতা এই লোকদের নেই। ব্যাংকের কেউ জড়িত না থাকলে এমন ঘটনা কেমনে ঘটে।’

তবে সোনালী ব্যাংকের তাড়াইল শাখা ব্যবস্থাপক মো. কাশেম উদ্দিন সঠিক নিয়মে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে দাবি করে বলেন, ‘আমরা কাগজপত্র দেখে কৃষিঋণ দিয়েছি। কিন্তু দালালচক্র এমন কাজ করবে আমি বুঝতে পারিনি। আমি বিষয়টি জানার পর থেকে এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি যেন টাকাগুলো দালালচক্রের হাত থেকে উদ্ধার করে জমা নেওয়া যায়।’ ভূমিহীন লোকদের কীভাবে কৃষিঋণ দিলেন, জানতে চাইলে তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

অভিযুক্ত ধলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক তনু মিয়ার খোঁজে উত্তরধলা গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে তালা ঝুলছে। তার প্রতিবেশী ও কাছের এক আত্মীয় জানান, বেশ কিছুদিন ধরে তনু মিয়া বাড়িতে নেই। তারা জানেন না, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় গেছেন।

অন্যদিকে আরেক অভিযুক্ত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হকেরও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। দু’জনেরই মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

এ দিকে কৃষিঋণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সোনালী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ প্রিন্সিপাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. মাহবুবুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্তদল রবিবার থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মাহবুবুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাড়াইল শাখায় কৃষিঋণ বিতরণে যে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত শুরু হয়েছে। এতে ব্যাংকের কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে এই শাখা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। এতে সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি অনুযায়ী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

/এফএস/ এপিএইচ/আপ-এসএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইয়াবাসহ যুবলীগ নেতা আটক
ইয়াবাসহ যুবলীগ নেতা আটক
সোসিয়েদাদকে হারিয়ে দুইয়ে ফিরেছে বার্সা 
সোসিয়েদাদকে হারিয়ে দুইয়ে ফিরেছে বার্সা 
দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে জরিমানা গুনলেন ১১ প্রার্থী
দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে জরিমানা গুনলেন ১১ প্রার্থী
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
সর্বাধিক পঠিত
ফুটপাত থেকে দোকান ছড়িয়েছে প্রধান সড়কে, আসছে নতুন পরিকল্পনা 
ফুটপাত থেকে দোকান ছড়িয়েছে প্রধান সড়কে, আসছে নতুন পরিকল্পনা 
ইয়াহিয়া সিনওয়ার: যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, শেষও কি তার হাতে?
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনইয়াহিয়া সিনওয়ার: যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, শেষও কি তার হাতে?
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
আমরা সুন্দর একটি সম্পর্ক মেন্টেইন করি: জয়া আহসান
বাংলা ট্রিবিউনের দশম বর্ষপূর্তিআমরা সুন্দর একটি সম্পর্ক মেন্টেইন করি: জয়া আহসান
রেল মন্ত্রণালয়ের গাড়ি নিয়ে চুরি করতে গিয়ে গ্রেফতার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার
রেল মন্ত্রণালয়ের গাড়ি নিয়ে চুরি করতে গিয়ে গ্রেফতার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার