‘ফুটপাত অবৈধ দখলে আছে’ বলায় মেয়র উত্তেজিত হয়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান পলাশকে মারধর করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন মেয়র ও প্রকৌশলী। সিটি করপোরেশন ভবনে গালাগালি ও মারধরের যে অভিযোগ করেছেন প্রকৌশলী পলাশ, সেটি অস্বীকার করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। মেয়র দাবি করেছেন, জনগণের স্বার্থে ড্রেন নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হলেও মারধরের ঘটনা ঘটেনি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর এলাকায় ড্রেন করা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের বিরোধ চলে আসছে। এলাকাবাসীর দাবি, গণপূর্তের নকশা অনুযায়ী ড্রেন করলে পানি সরবে না। ড্রেন তৈরি করতে হবে সোজা করে। কিন্তু গণপূর্তের কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনই বাঁকা ড্রেনের পরিকল্পনা দিয়েছে এবং সে অনুযায়ীই ড্রেন তৈরি করা হচ্ছে। এ নিয়ে গণপূর্ত কর্মকর্তাদের সিটি করপোরেশনে ডাকেন মেয়র। সেখানেই প্রকৌশলীকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ ওঠে। প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান পলাশ আজ মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী স্যারসহ আমরা মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে যাই। প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করার পর করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী তৈয়ব সাহেব আমাদের সিটি করপোরেশন ভবনের তৃতীয়তলায় সম্মেলন কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে মেয়র মহোদয় তৈয়ব সাহেবকে বলেন, ‘রাস্তা সোজা হবে এবং ১৭০ ফুট করবেন। যদি কেউ বাধা দেয় আমাকে বলবেন। এই শহরে আমার কাজ কে বাধা দেবে আমি দেখবো।”
আশরাফুজ্জামান পলাশ আরও বলেন, “মেয়র মহোদয় তৈয়ব সাহেবকে রাস্তা সোজা হওয়ার বিষয়টি বলার পর শামসুল আলম স্যার আমাকে পোর্ট কানেক্টিং সড়ক সংলগ্ন ওই জায়গার বিষয়ে মেয়র মহোদয়কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার নির্দেশ দেন। স্যারের নির্দেশ পেয়ে আমি মেয়র মহোদয়ের কাছাকাছি গিয়ে মেয়র মহোদয়কে বলি, স্যার আপনি বেয়াদবি না নিলে আমি বিষয়টি আপনাকে বুঝিয়ে বলতাম। এরপর মেয়র মহোদয়ের সম্মতি নিয়ে রাস্তার লে-আউট দেখিয়ে আমি মেয়র মহোদয়কে বলি রাস্তাটি ১২০ ফুট রয়েছে এবং সিটি করপোরেশনকে ১২০ ফুট জায়গা হস্তান্তর করা হয়েছে। তখন মেয়র মহোদয় বলেন, ‘আমি বলছি রাস্তা সোজা হবে, তাতে যত বড় হয় হবে’। তখন আমি বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পরামর্শ দেই। এ সময় মেয়র মহোদয় উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আমি নগরীর মালিক। আমার প্রয়োজনে যা দরকার আমি তা-ই করবো। কিসের আবার অনুমোদন। আমি আবার কার সাথে কথা বলবো। আমি যা বলেছি সেই হিসেবে কাজ হবে। কিসের আবার হাউজিং, হাউজিংয়ের সব জায়গা তো অবৈধ দখলে।”
প্রকৌশলী পলাশ বলেন, “হাউজিংয়ের সব জায়গা অবৈধ দখলে রয়েছে বলার পর আমি মেয়র মহোদয়কে বলি কিছু জায়গা অবৈধ দখলে আছে সত্য। তবে আমরা তো পর্যায়ক্রমে এগুলো উচ্ছেদ করছি। তখন মেয়র মহোদয় বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কোনও জায়গা অবৈধ দখলে নেই। পারলে একটি অবৈধ জায়গা দেখান।’ প্রথমে আমি চুপ থাকি। পরে আমি যখন বলি স্যার ফুটপাতের অনেক জায়গা অবৈধ দখলদারের দখলে। তখন মেয়র মহোদয় উত্তেজিত হয়ে যান এবং গালাগালি করতে করতে চেয়ার থেকে উঠে আমাকে থাপ্পড় মেরে গেঞ্জির কলার ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে হলরুমের বাইরে নিয়ে যান এবং গালাগাল করতে থাকেন।”
তিনি আরও বলে, ‘গালাগালের একপর্যায়ে তিনি আমাকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে আমি আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ জানানোর পর মেয়র মহোদয় গোপালগঞ্জ তুলে গালাগাল করেন। এ সময় ওখানে থাকা ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ জোবায়েরও আমাকে মারধর করেন।’
তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার সন্ধ্যায় সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ওই সহকারী প্রকৌশলীকে মেয়র মহোদয় থাপ্পড় মারেননি। আমিও তাকে কোনও মারধর করিনি। তিনি মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় মেয়র তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। এ সময় আমি তাকে হলরুম থেকে বের করে দেই। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা বসে পুনরায় কথা বলেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম হালিশহর হাউজিং সোসাইটির বরফকল এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন সংস্কারের কাজের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওপর পড়ে। এ ড্রেন সংস্কারের কাজে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। তখন এ বিষয়টি আমাদের ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ব আমাকে ফোন দিয়ে জানান। কিছুদিন আগে ওই এলাকার কিছু সম্মানিত ব্যক্তি অফিসে আসেন। তারা আমাকে জানিয়েছেন, এটি নিয়ে তাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ড্রেনের কাজ নিয়ে তারা সন্দিহান। ড্রেন যদি সংযুক্ত না হয় তাহলে বর্ষাকালে রাস্তায় পানি জমে যাবে। এলাকাবাসী ভোগান্তিতে পড়বেন।’
আ জ ম নাছির বলেন, ‘তখন এ নিয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয় এবং তাদের সন্ধ্যা ৭টায় আসতে বলি। তারা সন্ধ্যায় আসেন। আলোচনা শুরু করতেই উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান ওই সড়কের একটি ম্যাপ নিয়ে আমাকে দেখায়। যাতে রাস্তাটার বাঁক আগে যেরকম ছিল সেই রকম থাকে। ড্রেন যেন সোজা না করা হয়। তখন আমি উত্তেজিত হয়ে বলছিলাম, ড্রেন যেভাবে হচ্ছে, সেটা জনগণের সুবিধার্থে করা হচ্ছে। ড্রেন সোজা করলে আর পানি জমে থাকবে না। জনগণের ভোগান্তি কমবে। এখানে আমার কোনও স্বার্থ নেই। জনগণের কথা চিন্তা করেই ড্রেন এভাবে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অথচ তারা এই কাজে বাধা দিচ্ছে। আলোচনায় প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বারবার ড্রেন বাঁকা থেকে সোজা করার ব্যাপারে কথা বললে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ জোবায়ের উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলছিলেন, তুমি কার সঙ্গে বেয়াদবি করতেছো, তুমি জানো? উনি কে তুমি জানো? তোমার বাড়ি কোথায়? এসব বলতে বলতে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়।’
এদিকে এ ঘটনায় মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করেছেন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা কোনও কাজ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাসমুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এক সহকর্মীকে শারীরিক লাঞ্ছিত করে মেয়র মহোদয় আমাদেরকে অপমান করেছেন। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই। আমরা কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা চাই।’