আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল রাঙামাটির শিশু পরিবারের সদস্যরা। গত সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সেখানে ছিল স্বজনহীন ছেমন আরার গায়ে হলুদের আয়োজন। গায়ে হলুদ ছাড়াও বিয়ের আসরেও ছিল জমকালো সব আয়োজন। নাচে-গানে, গল্প-আড্ডায় পুরো আয়োজনই হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। ১০ বছর আগে রাস্তায় খুঁজে পাওয়ার পর আদালতের সিদ্ধান্তে ছেমন আরার ঠাঁই হয়েছিল রাঙামাটি শিশু পরিবারে। সেই এতিম শিশু ছেমন আরার ধুমধাম করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় মঙ্গলবার রাতে।
১০ বছর আগে ছেমন আরাকে রাস্তার ধারে খুঁজে পান কিছু পথচারী। শিশুটির কান্নায় পথচারীরা জানতে চান তার মা-বাবার নাম-ঠিকানা। কিন্তু সেদিন কিছুই জানাতে পারেনি সে। পরে আদালতের মাধ্যমে ছেমন আরাকে নিয়ে যাওয়া হয় সমাজ সেবা অধিদফতরের পরিচালনাধীন শিশু পরিবারে। এতিম সেই শিশুটি অন্যদের সঙ্গে শিশু পরিবারে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। সেই ছেমন আরার বয়স এখন ২০। শিশু পরিবারের উদ্যোগে ধুমধাম করে আয়োজন হয়েছে তার বিয়ে। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পর নতুন রূপে সেজেছে শিশু পরিবারটি।
ছেমন আরার বিয়েতে বাঙালি নারীর বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতাই পালন করা হয়। গত সোমবার রাতে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে শিশু পরিবারের সবাই হলুদ লাগিয়ে দেয় এবং শিশুদের পরিবেশনায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে তারা নিজেদের মতো নেচে-গেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বিয়ে উপলক্ষে শিশু পরিবারের সদস্য ও বরযাত্রীসহ ৩০০ জনের খাবারের আয়োজন করা হয়।
শিশু পরিবারের উদ্যোগে বর দ্বীন ইসলামকে যাচাই-বাছাই করে সামাজিকভাবে এই বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন শিশু পরিবারের সদস্য ছাড়াও জেলা প্রশাসক ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর শিশু পরিবারে এই প্রথম বিয়ের আয়োজন হয়েছে। আর বিয়ের আনন্দ আয়োজনে উচ্ছ্বাসে ভাসছে শিশু পরিবারের শিক্ষার্থীরাও। খুশি বর-কনে দুজনেই।
এই বিয়েতে মেয়ের উকিল বাবা ছিলেন সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ওমর ফারুক। সাক্ষী ছিলেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ ও রাঙামাটি ডিজিএফআইআরের অধিনায়ক কর্নেল জিএস মো. ইমরান। এছাড়াও কনে পক্ষের হয়ে বিয়েতে যোগ দেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদসহ রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমাতুজ জোহরা এবং রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
রাঙামাটি শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুর রশীদ বলেন, ‘ছেমন আরাসহ সব শিশুর নিজ সন্তানের মতো লালন পালন করে থাকি। একটা নিদির্ষ্ট সময় পরে মেয়েদের আর শিশু পরিবারে রাখার নিয়ম নেই। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হয় এবং পিতৃমাতৃহীন ছেমন আরাদের মতো অনেকের বিয়ের প্রয়োজন পড়ে। তাদের জন্য দায়িত্বটা আমাদের আরও বেশি। সেই দায়িত্ববোধ থেকে ছেমন আরার বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় খুশি হয়ে ছেমন আরা জানান, কখনও চিন্তা করতে পারেনি এভাবে জাঁকজমকভাবে বিয়ে হবে। এ আয়োজনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে কতৃজ্ঞতা এবং পাশাপাশি সহপাঠীদের জন্য তার মন কাঁদবে বলে জানান ছেমন আরা।
ছেমন আরার স্বামী মো. দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘আমি যথাসাধ্য তাকে সুখে রাখার চেষ্টা করবো।’ শাশুড়ি আঙ্গুনি বেগম বলেন, ‘যেহেতু সে দীর্ঘদিন পিতা-মাতাহীন অবস্থায় ছিল, আমি চেষ্টা করবো মায়ের আদর দিয়ে বাকিটা সময় একসঙ্গে থাকার।’
স্বজনহীন মেয়েটির সংসার সাজিয়ে দিতে পারায় স্বস্তি প্রকাশ করেন সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তারাও। রাঙামাটি সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘এ আয়োজন সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন সবাই।’
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ জানান, এতিম মেয়ের বিয়ের এই অনুষ্ঠানে শামিল হতে পারে তিনি খুবই আনন্দিত। তিনি নবদম্পতির সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করেছেন।