মাথার ওপর কড়া রোদ। হাওরজুড়ে এলোমেলো তপ্ত হাওয়া। নতুন সোনালি পাকা ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। গনগনে এই রোদের মধ্যেই যেন অন্যরকম উৎসব সবখানে। চলছে ধান কাটা।
কিশোরগঞ্জে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে দাবি করেছে কৃষি বিভাগ। তবে কৃষকরা বলছেন, দীর্ঘ খরা না থাকলে ফলন আরও বেশি হতো। এদিকে বেশির ভাগ ধান পেকে যাওয়ায় দ্রুত কাটা হচ্ছে। শ্রমিকরা ব্যস্ত রয়েছেন ধানকাটার কাজে। তবে ফলনে খুশি হলেও দামে হতাশা রয়েছে কৃষকদের। তবুও হাসি মুখেই কেটে যাচ্ছেন পরিশ্রমের ফসল। আর ধীরে ধীরে বাড়ছে কপালে চিন্তার ভাঁজ। লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা উঠবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন!
জেলার নিকলী উপজেলার বড় হাওরে পুরো পরিবার নিয়ে ধান সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষক আবুল কালাম। খরচ কমানোর জন্য স্ত্রী, তিন ছেলে ও শিশুকন্যাকে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে ধান কেটেছেন তিনি। এখন চলছে ঝাড়াইয়ের কাজ। তিনি জানালেন, ফলন ভালো হলেও খুশি হতে পারছেন না দামে। এ দামে ধান বিক্রি করে দেনা-পাওনা মিটিয়ে কিছু থাকবে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়।
আরেক কৃষক মজনু মিয়া ফলন কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নে জানালেন, এ বছর পাঁচ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ফলনও বেশ। ‘রোদে পুড়ে ফলানো ফসল বিক্রির সময় দাম না মিললে এমন ফসল ফলিয়ে কী হবে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। কিছুটা চুপচাপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘স্ত্রী, সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কীভাবে বছরের বাকি সময়টুকু পার করবো, কীভাবে ঋণ মেটাবো, সেই ভাবনাই এখন সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।’
হাওর অঞ্চলসহ পুরো জেলাতেই এখন একই দৃশ্য। দলবেঁধে ধানকাটা, মাড়াই আর রোদে শুকানো চলছে একসঙ্গে। বসে নেই নারী ও শিশুরাও। এরই মধ্যে হাওর অঞ্চলে ৬৫-৭০ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ, ৮০ ভাগ পাকলেই যেন কেটে ফেলা হয় সব ধান। এ বছর কেবল হাওর অঞ্চলেই ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন ধান কাটায়। কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ধান কাটার যন্ত্র কাজ করছে ৪১৩টি। ফলে দ্রুতবেগে চলছে ধান কাটা।
শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে ধান কাটছেন কামরুল মিয়াসহ ১২ জনের একটি দল। কামরুল বলেন, ‘আগে একাই কাজ করেছি। কিন্তু এখন দল বেঁধে কাজ না করলে পোষায় না। এক হলো, কৃষক ধান উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রি মেলাতে পারছেন না। অন্যদিকে শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিতেও তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির কারণে দিনদিনই কমছে ধানকাটার শ্রমিক। হাতের কাজে অনেক সময় লাগে। মূলত ছোট ছোট ক্ষেতের কৃষকরাই আমাদের কাজে লাগান। আর যাদের সক্ষমতা আছে, তারা মেশিনে ধান কাটায়।’
এবার নতুন জাতের ধানই বেশি চাষ করেছেন কৃষকরা। পুরনো জাতের মধ্য ব্রি-ধান ২৯-ও দেখা গেছে অনেক ক্ষেতে। নতুনের মধ্যে ব্রি-ধান ৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৮ এবং হাইব্রিডসহ সব ধানেরই ভালো ফলন হয়েছে। এ বছর বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও ভারিবৃষ্টি হলে ব্যাঘাত ঘটবে ধান কাটায়। এ কারণে দ্রুত ধান কাটায় মনোযোগী সবাই।
শুরুতে ধানের দাম এগার শ টাকা থাকলেও এ দাম এখন অনেকটা কমে গেছে। বর্তমানে ৪০ কেজি কাঁচা ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। কৃষকদের অভিযোগ, ধান চাষে খরচ হয় বারো শ’ টাকার মতো। আর দীর্ঘ খরার কারণে এবার সেচে খরচ হয়েছে অন্যবারের চেয়ে দ্বিগুণ। এভাবে লোকসান দিলে ধান চাষে আগ্রহ হারাবেন তারা। সরকারের উচিত ফসলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরোচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। চাষ হয়েছে আরও কিছু বেশি জমিতে। কেবল হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। এসব চাল জেলার চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে পাঠানো যাবে বলেও মনে করছেন তারা। সব ঠিকঠাক থাকলে মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যেই হাওরের সব ধান কাটা হয়ে যাবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
এদিকে, এবার সরকারিভাবে যে ধান কেনা হচ্ছে সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। উৎপাদনে প্রায় ১২ লাখ টন চাল পাওয়া গেলেও সরকারিভাবে কেনা হচ্ছে মাত্র ১২ হাজার টন চাল। এতে অল্প সংখ্যক কৃষকরা লাভবান হবেন। বাকি ধান কৃষকরা ধান ব্যসবসায়ীদের কাছেই বিক্রি করবেন, ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত দামে। তাই ধান বিক্রিতে কৃষকরা যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হন, ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেন, সেদিকে সরকারের দৃষ্টি রাখার প্রত্যাশা হাওরাঞ্চলের কৃষকদের।