গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক হৃদয়কে (১৯) চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মারধরের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রথমে গোপন করার চেষ্টা করায় বিলম্বে ঘটনাটি প্রকাশ পায়।
জানা গেছে, শুক্রবার (২৭ জুন) রাত আনুমানিক ৮টা থেকে শনিবার (২৮ জুন) বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৪টার মধ্যে মহানগরীর কোনাবাড়ী থানাধীন কাশিমপুর রোডের গ্রিনল্যান্ড নামে ওই কারখানায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত হৃদয় টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার শুকতারবাইদ গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তিনি ওই কারখানায় ডাইং সেকশনের মেকানিক্যাল মিস্ত্রি হিসেবে অস্থায়ীভাবে কাজ করতেন। গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থানাধীন হারিনাবাড়ী (এসরারনগর হাউজিং) এলাকায় ভাড়া থাকতেন।
এ ঘটনায় শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় নিহতের বড় ভাই লিটন মিয়া বাদী হয়ে কোনাবাড়ী থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় হাসান মাহমুদ মিঠুন (২৮) নামে একজনকে রবিবার রাতে গ্রেফতার করেছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতার হাসান মাহমুদ মিঠুন টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার হাদিরা বাজার গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থানাধীন কুদ্দুসনগর এলাকায় ভাড়া থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, শনিবার সকালে চুরির মিথ্যা চোর অপবাদ দিয়ে গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টসের নিরাপত্তা কর্মীরা হৃদয়ের হাত-পা বেঁধে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। পরে সেখানে তাকে নির্মম নির্যাতন ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে দুপুরের দিকে হৃদয় মারা যান। ঘটনার খবর আশপাশের অন্যান্য গার্মেন্টসে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে ৪০০-৫০০ শ্রমিক টাঙ্গাইল-গাজীপুর সড়কে নেমে আসেন এবং গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টসের সামনে গিয়ে কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের সহকর্মী হৃদয় হত্যার বিচার দাবি করেন। এ সময় তারা কয়েক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পরে তারা লাশের সন্ধান চাইলে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজে আছে বলে জানানো হয়। সেখানে গিয়ে গিয়ে তারা মরদেহটি শনাক্ত করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। হত্যার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ মূল ফটকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিশ সাঁটিয়ে পালিয়ে যায়।
হৃদয়কে মারধরের ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, তাকে কারখানার একটি কক্ষের জানালার সঙ্গে দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে খালি গায়ে একটি সোফার ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হৃদয়ের মুখ ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। তার জিন্সের প্যান্টেও রক্তের দাগ লেগে ছিল। এ সময় আশপাশের কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এত করে পিটানো হইছে, তারপরও কিছুই হয় নাই, মরে নাই।’
হৃদয় মারা যাওয়ার পর তাকে মারধরের একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায় হাঁটুতে, কোমরে, পিঠে, হাতের কব্জিতে, কনুইতে, হাতের নখে, গলায় এবং মুখমণ্ডলে রক্তাক্ত ও কালচে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এসব থেকে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা অনুমান করা যায়।
ভিডিওর আরেক অংশে দেখা যায়, হৃদয়কে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটি কক্ষ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করছেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে একজনের হাতে কাঠের লাঠি ছিল। তখনও পিঠের দিকে হাত মুড়িয়ে মাঝে লাঠি ঢুকিয়ে রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ছিল হৃদয়। রশির একটি অংশ দিয়ে তার দুই পাও বাঁধা ছিল। ওই অবস্থায় কয়েকজন তাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হৃদয় ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলেন না। শনিবার সকাল ১০টা ১৪ মিনিটে কারখানা ভেতরে একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে দেখা যায়। মৃত অবস্থায় হৃদয়কে নিয়ে ১০টা ২১ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্সটি কারখানা ত্যাগ করে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, ‘প্রথমে আমাদের কাছে খবর আসে একজন চোর কারখানার দেয়াল টপকে ভেতরে আসার সময় ড্রেনে পরে আহত হয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, ওই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা শোনার পর আমরা গ্রিনল্যান্ড কারখানায় অভিযান চালিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ এবং হত্যায় ব্যবহৃত অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা নিশ্চিত হই এটি হত্যাকাণ্ড।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফুটেজ দেখা গেছে, শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার পরে কারখানার ভেতরে হৃদয়কে নির্যাতন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাতেই হৃদয় মারা যায়। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে শনিবার সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে হৃদয়ের লাশ গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা ঘটনা জানতে পেরে বিক্ষোভ করেন ও আমরা খবর পাই।
‘ধারণা করা হচ্ছে, কারখানার ভেতরে নির্যাতনে হৃদয়ের মৃত্যুর ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে আহত দেখিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল রেজিস্ট্রারে তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পরে পুলিশ মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে স্থানান্তর করে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা নিশ্চিত হই এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় আমরা ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করি এবং অভিযান চালিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে গ্রেফতার করি। জড়িত বাকিদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের একাধিক টিম বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে।’
বাদী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, হৃদয় মা ও বোনের সঙ্গে কোনাবাড়ী থানাধীন হরিনাচালা এসরারনগর হাউজিং এলাকায় মিরাজের বাসায় ভাড়া থেকে গ্রিনল্যান্ড লিমিটেড গার্মেন্টসে মেকানিক্যাল মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বাদীর মা মোবাইলে ফোন করে বাদীকে জানান, গত ২৭ জুন রাত আনুমানিক ৮টায় হৃদয় খাওয়া-দাওয়া শেষে ডিউটির উদ্দেশ্যে বাসা হতে বের হয়ে যান এবং ডিউটি শেষ করে এখন পর্যন্ত বাসায় ফিরে আসেননি। এই সংবাদ পেয়ে বাদী তাৎক্ষণিক মায়ের বাসায় এসে মাকে নিয়ে হৃদয়ের অফিসে যান। সেখানে গিয়ে লোকজনের কাছে জানতে পারেন হৃদয়ের মৃত্যুর বিষয়ে গ্রিনল্যান্ড লিমিটেড গার্মেন্টসের শ্রমিকরা টাঙ্গাইল-গাজীপুর সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন। তখন পরিবারের লোকজন হৃদয়ের লাশের সন্ধান করলে ওই কারখানার লোকজন জানায়, লাশ গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। পরে পরিবারের লোকজন হাসপাতালে গিয়ে হৃদয়ের লাশ শনাক্ত করেন।