বরিশাল নগরের সিঅ্যান্ডবি সড়কটি ঢাকা-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কের অংশ। নগরের চৌমাথা এলাকায় মহাসড়কের একটি বাইলেন (পার্শ্ব সড়ক) ও দুই ব্যক্তির জমি দখল করে মায়ের নামে শিশুপার্ক নির্মাণ করেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। আট কোটি টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিতভাবে পার্কটি করে অর্থ অপচয় করা হয়েছে। সড়কের এই অংশ সড়ক ও জনপথের (সওজ) আওতায় থাকলেও সংস্থাটির অনুমতি নেওয়া হয়নি। ব্যস্ততম মহাসড়কের পাশে পার্ক নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। তাতে কোনও কর্ণপাত করেননি সাদিক আব্দুল্লাহ। অবশেষে স্থাপনাটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সওজ।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, সওজের আওতাধীন ঢাকা-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কটির প্রায় ১১ কিলোমিটার অংশ বরিশাল নগরের মধ্য দিয়ে গেছে। ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত দুই লেনের জাতীয় এই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ার কথা আছে। এই প্রকল্পের আওতায় এই অংশও রয়েছে। ফলে পার্ক অপসারণ করতে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, পার্কটি নির্মিত হওয়ার ফলে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। সড়ক বড় করতে হলে স্থাপনাটি ভাঙতে হবে। পাশাপাশি এটি নির্মাণ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৫০টি পরিবারের যাতায়াতের সহজ পথ। সেইসঙ্গে পার্কে যাতায়াতে ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরাও।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে মহাসড়কের একটি বাইলেন ও অন্য দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন জমি দখল করে পার্ক করেন সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। মৃত মায়ের নাম অনুসারে এটির নামকরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম পার্ক। ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করা হয়।
সওজের বরিশাল বিভাগীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পার্কটি নির্মাণের জন্য মহাসড়কের পাশে থাকা ২৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করেছিল সিটি করপোরেশন। ওসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে সিঅ্যান্ডবি সড়কের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের লেকের উত্তর পাড় থেকে কাজীপাড়া সড়কের মুখ পর্যন্ত মূল মহাসড়ক ও বাইলেনের মধ্যের সড়ক বিভাজক ভেঙে ফেলা হয়েছিল। মহাসড়কের বাইলেন অংশে পার্কের একটি অংশ পড়ায় পাশের ড্রেন ভাঙা হয়েছে। এমনকি পার্কের সঙ্গে হোটেলের জন্য হাতেম আলী কলেজের জমি দখল করে দোতলা গোল চত্বর নির্মাণ করা হয়। এসবের জন্য সওজ কিংবা ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি নেওয়া হয়নি। সড়কের সাড়ে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩০ ফুট প্রস্থের জায়গা দখল করে আট কোটি টাকায় এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ঠিকাদার ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না।
তবে শুরু থেকে নগরবাসী এবং সুশীল সমাজ এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও সাদিক আব্দুল্লাহ কারও কথা শোনেননি। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির মালিকরা আদালতের দ্বারস্থ হলে পার্ক নির্মাণের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাও মানেননি সাদিক। ক্ষমতার জোরে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মাণ শেষ করে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে দোয়া মোনাজাতের মধ্য দিয়ে পার্কের উদ্বোধন করেন।
পার্কের আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন, পার্ক নির্মাণের ফলে চৌমাথা এলাকায় যানবাহন চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। দুই দিকে চওড়া মহাসড়ক পার হয়ে পার্কের সামনে এসে সড়ক সরু হয়ে যাওয়ায় দুই দিকের যানবাহনের সংঘর্ষে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট পার্কের সব রাইড ভাঙচুর করে লুটপাট চালানো হয়। ওই দিন নগরের আরও কয়েকটি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় নগরবাসী উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পার্ক ভাঙচুরে অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। এটি সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সবাই। এ অবস্থায় তা অপসারণের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে সওজ। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, ‘চৌমাথায় পার্কের পেছনের অংশে অর্ধশতাধিক পরিবার বসবাস করে। বাড়ি থেকে তাদের দুই-তিন মিনিটে সিঅ্যান্ডবি রোড যাওয়ার সড়কটি আটকে দিয়ে পার্ক করা হয়। এখন সিঅ্যান্ডবি রোডে যেতে তাদের প্রায় আধা কিলোমিটার পথ ঘুরতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে সড়কের জায়গা দখল করে পার্ক করায় আশপাশের সব মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এটি সরালে সবার উপকার হবে।’
সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন, হাতেম আলী কলেজ এবং সওজের জমি দখল করে পার্কটি করা হয়েছে। সেখানে ২৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল, সবগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে পার্ক নির্মাণ বন্ধে দুই জন মালিক হাইকোর্টে মামলা করলে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু স্থগিতাদেশ মানেননি সাদিক আব্দুল্লাহ। পরে ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও তাদের দেওয়া হয়নি।’
বরিশালের সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে সড়কের ওপর পার্ক নির্মাণ ছিল জনস্বার্থবিরোধী। এতে জনগণের অর্থ অপচয় হয়েছে। যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পার্কটি নির্মাণের ফলে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই দায় এড়াতে পারে না। তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। সেইসঙ্গে নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধেও ব্যবসা নেওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশালের সদস্যসচিব রফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পার্কটি নির্মাণের সময় থেকে বিরোধিতা করে আসছিলাম আমরা। বারবার বলা হয়েছে এটি অপরিকল্পিত এবং বিধ্বংসী। কিন্তু তৎকালীন সিটি মেয়র ক্ষমতার জোরে মহাসড়ক দখল করে এটি করেছেন। এখন এটি অপসারণ করা হবে। কিন্তু জনগণের যে কোটি কোটি টাকা অপচয় হলো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ ও অন্যের জমি দখল করা হলো; তার বিচার করবে কে? এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেখতে হবে, প্রকল্পটি করার আগে কোনও ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল কিনা। কীসের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলো। সেখান থেকে সব তথ্য-উপাত্ত বের হবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সড়ক ও জনপথের (সওজ) বরিশাল বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চৌমাথা এলাকায় মহাসড়ক দখল করে পার্কটি নির্মাণ করেছিল সিটি করপোরেশন। তৎকালীন সিটি মেয়রের নির্দেশে এটি করা হয়েছিল। সড়কের ওই অংশ সওজের আওতায় থাকলেও আমাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি। এখন ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত দুই লেনের জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান আছে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই সড়কের ওপর পার্কটি রাখা সম্ভব হবে না। সেটি অপসারণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করে মহাসড়ক অবমুক্ত করে দেওয়া হবে।’
যারা অপরিকল্পিতভাবে পার্কটি করে আট কোটি টাকা অপচয় করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে জানাবো। এরপর দুদিন ধরে কল দিলেও রিসিভ করেননি।’