X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহা হত্যা মামলা: চার্জশিটে যা আছে

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার 
৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৮আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৮

কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে শামলাপুর বাজারের কাছে পুলিশ চেকপোস্টে গত ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন । মামলাটি তদন্তের জন্য দায়িত্বপান কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর এএসপি মো. খাইরুল ইসলাম। উক্ত মামলায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা ও র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। এতে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান তার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে প্রতিদিনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভিডিও ধারণের জন্য টেকনাফ থানার মারিশ বুনিয়ার মুইন্ন্যা পাহাড়ের উদ্দেশে প্রাইভেটকারে রওনা হন। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ রাস্তার পাশে গাড়িটি পার্ক করে তারা পাহাড়ের দিকে রওনা হন। তার পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাকের মতো কমব্যাট প্যান্ট ও কমব্যাট গেঞ্জি। সঙ্গে ছিল ভিডিও ধারণের ক্যামেরা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ওই দিন পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশবুনিয়ার মাথাভাঙ্গা জামে মসজিদের ইমামের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদের সালাম বিনিময় হয়। পথে একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তারা পাহাড়ে ওঠার পথও জেনে নেন। এরপর তারা ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার জন্য মুইন্ন্যা পাহাড়ে ওঠেন। অতঃপর পাহাড় ও সমুদ্রের চিত্র ধারণ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে। 

এরই মধ্যে পুলিশের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াজ লোক মারফত জানতে পারেন মুইন্ন্যা পাহাড়ে ভিডিও ধারণের জন্য দুজন লোক উঠেছে। তারা আরও জানতে পারেন তাদের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত এবং তাদের সঙ্গে ক্যামেরা রয়েছে। এতে তারা নিশ্চিত হন তারাই সে ভিডিও পার্টি, যাদের খুঁজে বের করার জন্য ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। এরপর রাত ৮টার দিকে নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ মেজর সিনহা মো. রাশেদকে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলীর 

পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সেজন্য দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে তারা ঘোষণা করেন পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। তখন কিছু লোক জড়ো হয়। কিন্তু, পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় লোকজনের কাছে তারা ডাকাতির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এর পরেও দমে যাননি নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ। তারা মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. জহিরুল ইসলামকে দিয়ে মাইকে অনুরূপ ঘোষণা দেওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, হাফেজ জহিরুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনদের বলেন, উক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ সিনহা মো. রাশেদ খান ডাকাত নয়, আর্মির লোক। পাহাড়ে ওঠার আগে তার সঙ্গে মেজর সাহেবের দেখা হয়েছে এবং সালাম বিনিময় হয়েছে। এ কথা বলায় লোকজন চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সিনহা মো. রাশেদ ও সিফাত পাহাড় থেকে আইয়াজ, নুরুল আমিন ও নিজাম উদ্দিনের সামনে দিয়ে নেমে আসেন। সে সময় নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ তাদের হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হন এরাই সে ভিডিও দল।

অভিযোগপত্রের ১৩ নম্বর পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে। এরপর রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছালে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য রাজীব গাড়িটি থামান। তখন রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে গাড়ির বাঁ-পাশের আসনে বসা সিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। এ সময় ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা মো. রাশেদ নিজের পরিচয় দেন। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর রাজীব এবং অন্য দুজন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও আবদুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন। 

মেজর সিনহা তখন গাড়িটি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। হঠাৎ মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের নাম শুনেই মো. লিয়াকত আলী চিৎকার করে গাড়িটির সামনে চলে আসেন এবং আবার তাদের পরিচয় জানতে চান। পুনরায় মেজর (অব.) সিনহা নিজের পরিচয় দেন। তখন লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে আবার ব্যারিকেড তুলে রাস্তা বন্ধ করে দেন। 

এ কাজে এসআই নন্দ দুলালও সহযোগিতা করেন। এরপর লিয়াকত আলী পিস্তল তাক করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সিনহা মো. রাশেদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং গাড়ির সব যাত্রীকে দুই হাত ওপরে তুলে নেমে আসতে বলেন। হঠাৎ তার চিৎকারে রাস্তার দু’পাশে চলাচল করতে থাকা লোকজনও হতচকিত হয়ে যান এবং ঘটনাস্থলে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য পথচারীরা দাঁড়িয়ে যান। এ চেকপোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার লাইট দিয়ে আলোকিত করা ছিল এবং এতে আশপাশের মসজিদ, বাজার ও রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন পরিষ্কারভাবে সব কিছু দেখতে পেতেন।

অভিযোগপত্রের ১৪ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। তখন গাড়ির দুই নম্বর আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। ড্রাইভিং সিটে বসা মেজর সিনহাও দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কাম ডাউন’, ‘কাম ডাউন’ বলেন এবং লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। লিয়াকত আলী মেজর সিনহার পরিচয় জেনে তার কোনো কথা না শুনে এবং তাকে কোনো সময় না দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে প্রথমে দুই রাউন্ড গুলি করেন এবং কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন। এতে মেজর সিনহা রাস্তায় পড়ে যান। গুলি করার পর লিয়াকত আলী মেজর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন। তখন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত আহত সিনহা মো রাশেদকে হাতকড়া পরান। কিন্তু, এসআই মো. শাহাজাহান আলীর কাছে হাতকড়া না থাকায় লিয়াকত তাকে গালমন্দ করেন এবং রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। তখন কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে ইমন পাশের শামলাপুর বাজারের দোকান থেকে রশি এনে এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল রাজিবের সহযোগিতায় সিফাতকে রশি দিয়ে বাঁধেন। 

ঘটনার পর লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা বলেন এবং তিনি ওসি প্রদীপকে ঘটনাটি জানান। এর কিছুক্ষণ পর রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে লিয়াকত আলী ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানান। সিনহা মো. রাশেদ তখনও জীবিত ও সজাগ ছিলেন এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে মেজর সিনহা একটু পানি খাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। এটা শুনে এবং তাকে তখনও জীবিত অবস্থায় দেখে লিয়াকত আলী আরও উত্তেজিত ওঠেন। 

তিনি সিনহাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য?’ এরপর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যান এবং তার বুকের বাঁ-পাশে জোরে কয়েকটি লাথি মারেন এবং পা দিয়ে বুক চেপে ধরেন। এরই মধ্যে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ পাঠাতে বলেন। নন্দ দুলাল রক্ষিতের ফোন পেয়ে তদন্ত কেন্দ্র থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এএসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, ছাফানুল করিম ও কামাল হোসেন আজাদ সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর লিয়াকত আলী এপিবিএন সদস্য এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিমকে সিনহা মো. রাশেদের গাড়িটি তল্লাশি করতে বলেন। তাঁরা গাড়ির ভেতরে সামনের দুই সিটের মাঝখান থেকে একটি অস্ত্র, ড্যাশবোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স এবং ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পান। তখন গাড়িতে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। পুরো ঘটনাটি রাস্তার দুপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী, পথচারী, মসজিদ, বাজার ও জেলেঘাটের লোকজন চেকপোস্টের পরিষ্কার আলোয় প্রত্যক্ষ করেন। সেদিন চাঁদ রাত হওয়ায় সেখানে লোক সমাগমও বেশি ছিল।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ একটি সাদা মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে তার ফোর্সসহ দ্রুতগতিতে রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর প্রদীপ ও লিয়াকত আলী একান্তে কিছু সময় আলাপ করেন। তারপর প্রদীপ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান। তখন প্রদীপ দম্ভোক্তি করে বলেন, ‘অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি।’ তারপর প্রদীপ প্রথমে মেজর সিনহাকে পা দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন। সিনহা তখনও জীবিত ছিলেন এবং পানি চাচ্ছিলেন। প্রদীপ তখন তার পায়ের জুতা দিয়ে মেজর সিনহার গলা চেপে ধরেন এবং একপর্যায়ে সিনহার শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনও প্রদীপ, লিয়াকত এবং সঙ্গে থাকা ফোর্সের কেউই সিনহার পড়ে থাকা দেহটি হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ না নিয়ে ঘটনাস্থলে ফেলে রাখেন। 

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ওসি প্রদীপ তার সঙ্গে থাকা ফোর্সের মাধ্যমে মেজর সিনহার গাড়িটি পুনরায় তল্লাশি করে মাদক খুঁজে বের করতে বলেন। তার সঙ্গে আসা টেকনাফ থানার সাগর দেব ও রুবেল শর্মা নিজেদের বহনকারী মাইক্রোবাসের দিকে যান এবং এর কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চিৎকার করে বলেন, মেজর সিনহার গাড়ির ভেতরে মাদক পাওয়া গেছে। এরপর ওসি প্রদীপের নির্দেশে তার সঙ্গে থাকা ফোর্স মেজর সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের হাত বেঁধে চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে যান। সেখানে তারা তার মুখের ওপর পানি ঢেলে অবর্ণনীয় কায়দায় নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ চালান।  এ সময়ের সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সিনহা মো. রাশেদকে হাসপাতালে নেওয়ার কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায় সোয়া ঘণ্টা বিলম্বিত করা হয়েছে। সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী অস্বাভাবিক দেরিতে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। পরে এএসআই লিটন এবং কনস্টেবল কামাল হোসেন আজাদ ও সাফানুল করিম মেজর সিনহাকে একটি পিকআপে তুলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলার অভিযোগপত্রের ১১ নম্বর পাতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, মামলার এজাহারনামীয় ২ নম্বর আসামি প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা থেকে ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং অন্যায় ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়াও স্থানীয় মোটামুটি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নিরীহ পরিবারকে নিশানা করেন। এরপর তাদের মিথ্যা মামলা জড়িয়ে, অনেক লোকজনকে ক্রসফায়ার দিয়ে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে আদায়ের নির্মম নেশায় লিপ্ত হন বলে জানা যায়।

চার্জশীটে আরও উল্লেখ করা হয়, ওসি প্রদীপ ২০১৮ সালের টেকনাফ থানায় যোগদানের পর তার নেতৃত্বে ও নির্দেশে শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বহু লোক মারা যায়। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধ প্রক্রিয়া (মডাস অপারেন্ডি) ছিল কোনও ঘটনায় মাদক উদ্ধার হলে অথবা টার্গেট কোনও ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হলে (ফিটিং মামলা) প্রথমত, আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর স্থানীয় কিছু শ্রেণির লোকজনসহ তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য দেন-দরবার করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ক্রসফায়ার না দেওয়ার শর্তে আদায় করা হতো। প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ আশানুরূপ বা চাহিদানুরূপ হলে ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে মাদক উদ্ধার দেখিয়ে উক্ত ব্যক্তির বা আসামির আত্মীয়-স্বজনদের মামলার আসামি করা হতো। 

এ ক্ষেত্রে নারী, বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী কেউ তার আক্রোশ থেকে রেহাই পেতো না। এমনকি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও করা হতো বলে তদন্তে জানা যায় এবং এ বিষয়ে আদালতে মামলা হয়েছে বলেও জানা যায়। এরপর শুরু হতো তার অন্যরকম অবৈধ অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, তার দায়ের করা মামলার কথিত এজাহারে বর্ণিত আসামিদের ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ আসামির সৃজিত সম্পত্তি হতে বেদখল করে এবং ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা। এ কাজ করার জন্য তিনি (প্রদীপ) তার সমমনা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন।

অভিযোগপত্রের ১১ নম্বর পাতার শেষ অনুচ্ছেদে সাবেক ওসি প্রদীপ সম্পর্কে আরও উল্লেখ করা হয় তাঁর এ ধরনের অপরাধকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতো না। যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছে, তারা এবং তাদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়-স্বজন তার অত্যাচার, নিপীড়নসহ মামলা-হামলার শিকার হতো। তিনি টেকনাফ থানায় যোগদান করেই স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং মাদক নির্মূলের অজুহাতে এবং নিজেকে সরকারের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক দেখানোর আড়ালে জনগণ তথা সরকারি দল-মতের তোয়াক্কা না করে পুরো থানা এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে সমাজ ও জনপদে ত্রাস সৃষ্টি করে অপরাধের অভয়ারণ্য এবং অপরাধ কর্মের রাজত্ব কায়েম করেছিল বলে জানা যায়। 

তার এ ধরনের অপরাধ কর্মের প্রচার ও প্রসার রোধে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার দলবল স্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে রাখতেন বলে জানা যায়। এতেও কাজ না হলে ভয়ভীতি, হুমকি প্রদর্শনসহ মামলায় জড়িয়ে কণ্ঠরোধ করা হতো। তার কু-কর্মের বিষয়ে কেউ যাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে এবং প্রচার করতে না পারে সে বিষয়ে প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন খুব সোচ্চার ও সতর্ক। এ ধরনের লোকজনের তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি থানায় এলাকাভিত্তিক সোর্স নিয়োগ করে রাখতেন।

চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, মেজর (অব.) সিনহা হত্যার আগেও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অপকর্মের খবরাখবর প্রচার হয়। তবে তাকে থামানো বা প্রতিরোধে কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমান উদাসীন ছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বনামধন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার সংবাদে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও তৎকালীন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করে অপেশাদারি ও অবহেলামূলক আচরণ করেছেন।

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমানের এসব আচরণ প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং জনমনে তার পক্ষপাতিত্বমূলক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে বলে মনে হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং অপরাধীদের শনাক্ত করার বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদুর রহমানের তদারকি এবং দায়িত্ব পালনে আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল।

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয় নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান গুলিবদ্ধ হওয়ার সংবাদ অবগত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে হাসপাতালে পাঠানোসহ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপারের সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা বা মনিটরিং দেখা যায়নি। এছাড়া প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে তদারকিতে পুলিশ সুপারের ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। পুলিশ সুপারের এমন অবহেলামূলক ও দায়িত্বহীন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করার বিষয়ে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

 

/টিটি/ 
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা