বাংলাদেশ-মিয়ানমার নাফনদ সীমান্ত ঘেঁষা শেষ প্রান্ত শাহপরীর দ্বীপ। টেকনাফ থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ দ্বীপে অবস্থিত করিডোর। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে যে গরু আসে, সেগুলো প্রথমে রাখা হয় শাহপরীর দ্বীপ করিডোরে। এরপর বিজিবির তদারকিতে টেকনাফ গবাদিপশু শুল্ক করিডোরের মাধ্যমে ভ্যাট প্রদান করা হয়। পরে সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী গরু পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এই করিডোর ধরে পশু আনার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকলেও, গত সাত মাস ধরে মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি বন্ধ রয়েছে। গরু বেচাকেনার করিডোর এখন খাঁ খাঁ করছে। এতে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং আমদানির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট শত শত দিনমজুর পরিবারের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুল্ক বিভাগ জানায়, চোরাই পথে গবাদি পশু আসা রোধে ২০০৩ সালে ২৫ মে শাহপরীর দ্বীপ করিডোর চালু করে সরকার। করিডোর প্রতিষ্ঠার পর গবাদি পশু আমদানি থেকে সরকার প্রায় ১৮ বছরে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আয় করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সীমান্ত ঘেঁষা নাফনদে দ্বীপের করিডোরে মিয়ানমার থেকে আসা গরু-মহিষ দ্বীপের জেটি ও বাঁধের আশপাশ এলাকা খালি পড়ে আছে। নেই কোনও মানুষের আনাগোনা।
কথা হয় নাফনদে জেটি ঘাটে বসে থাকা মোহাম্মদ কাশেমের সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে ১০ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে পশুবাহী ট্রলার খালাসের কাজে নিয়োজিত তিনি। তিনি বলেন, ‘সাত মাস ধরে মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু আসা বন্ধ। এতে আমাদের সংসারেও দুর্দিন চলছে। এত দিন ধরে করিডোরে কাজ করে দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করতাম। সেগুলো নিয়ে ভালো মতো সংসার চলতো। আর এখন খুবই খারাপ অবস্থা। মিয়ানমার থেকে আসা পশুবাহী ট্রলার খালাসের সঙ্গে চার ধরনের প্রায় আড়াইশ' দিন মজুর কাজ করে থাকে। আজ তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবা রোধে দীর্ঘদিন ধরে নাফনদে জেলেদের মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। তবু কি এসব বন্ধ হয়েছে? সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ নদীতে মাছ শিকার বন্ধের কারণে করিডোরে কাজে জড়িয়েছিলেন। তবে দীর্ঘ আট মাস বন্ধ থাকায় অভাবের কারণে অনেকে আবার মাদক বহনে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে সব দিক বিবেচনা করে সরকারের কাছে অনুরোধ, অন্তত অসহায় পরিবারের কথা ভেবে দীর্ঘদিনের করিডোরটি পুনরায় চালু করা হোক।’
এদিকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে গত বছরের ৯ জুলাই দেশের খামারিদের কথা চিন্তা করে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপে মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। অন্যদিকে কক্সবাজারে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাসহ ৩৫ লাখ মানুষের বসতি। ফলে এই অঞ্চলে গরুর চাহিদাও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা মাংসের দামও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এ করিডোরের সঙ্গে হাজারও মানুষের জীবিকা জড়িত উল্লেখ করে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ করিডোরের আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুল্লাহ মনির জানান, ‘আট মাস মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু আসা বন্ধ। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কয়েকশ' শ্রমিকের পরিবার কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে কিছু ব্যবসায়ী সেদেশে পশু কেনার টাকা দিয়েও পশু আনতে পারছে না। এতে তারা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। ফলে এ সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
শাহপরীর দ্বীপ করিডোর চালু থাকলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থলবন্দরের কর্মকর্তা মো. শাহীন আক্তার।
এছাড়া টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে পশু আমদানিতে কোনও বাধা নেই। সরকারি নির্দেশে মিয়ানমার থেকে পশু আসা বন্ধ রয়েছে। নির্দেশনা পেলে পুনরায় বিজিবি কাজ করবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফের ইউএনও পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনায় ঈদের আগ থেকে মিয়ানমার থেকে পশু আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে, এখনও সেটি বলবৎ রয়েছে। তবে এটা সত্য করিডোরে কার্যক্রমের সঙ্গে কিছু গরিব মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। তাদের বিষয়টি আলাদাভাবে চিন্তা করা হচ্ছে।’
শুল্ক বিভাগ জানায়, শাহপরীর দ্বীপ করিডোর চালুর পর মিয়ানমারের গরু-মহিষ ও ছাগল আমদানি থেকে সরকার ১৮ বছরে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আয় করে। তার মধ্যে ২০০২-০৩ অর্থ বছরে দুই লাখ ৪০ হাজার, ২০০৩-০৪ অর্থ বছরে ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ টাকা, ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে ৭৬ লাখ সাড়ে ২১ হাজার, ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে এক কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা, ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে এক কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার ২০০ টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে ৯০ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে এক কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে এক কোটি ৬৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, ২০১০-১১ অর্থ বছরে এক কোটি ৬৬ হাজার ৭৩ হাজার টাকা, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার ২০০ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এক কোটি ৬১ হাজার টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এক কোটি ১৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এক কোটি ২৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে এক কোটি ৩৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে তিন কোটি ৩৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছয় কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তিন কোটি ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তিন কোটি ৩৮ লাখ ৫ হাজার টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে তিন কোটি ৮৬ লাখ ১২ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করেছে সরকার।