চট্টগ্রাম কারাগারে রুবেল দে (৩৮) নামে এক বন্দির অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগে সিনিয়র জেল সুপার, জেলারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে মামলার আবেদন করেন রুবেলের স্ত্রী পুরবী পালিত। আদালত আবেদন গ্রহণ করেছেন। সেইসঙ্গে যাচাই-বাচাই করে পরবর্তীতে শুনানির জন্য রেখেছেন বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী অজয় ধর।
গত ২৭ জানুয়ারি চোলাই মদ উদ্ধারের ঘটনায় করা মামলায় রুবেলকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় বোয়ালখালী থানা পুলিশ। ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কারাগার থেকে রুবেলের মৃত্যুর খবর পান স্বজনরা।
যাদের আসামি করে মামলার আবেদন করা হয়েছে তারা হলেন চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, জেলার মোহাম্মদ এমরান হোসেন মিঞা, ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়া, মো. আখেরুল ইসলাম, সুমাইয়া খাতুন, ইব্রাহিম, কারাগারের পদ্মা ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টার, বোয়ালখালী থানার ওসি মো. আছহাব উদ্দিন, একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাইফুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) এসএম আবু মুসা, রিজাউল জব্বার, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাঈন উদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম, কনস্টেবল কামাল, আসাদুল্লাহ ও ঘটনার দিন থানার ডিউটি অফিসার। এছাড়া অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আব্দুর রশীদ বলেন, ‘আদালত আবেদন গ্রহণ করে যাচাই-বাছাইয়ের পর শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন।’
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ জৈষ্ঠপুরা বেনী মাধবের বাড়ির বাসিন্দা তারা। গত ২৭ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় বাড়ি থেকে রুবেলকে স্থানীয় চৌকিদার জয় চক্রবর্তী এবং ইউপি সদস্য চৌধুরী মো. হাসান চৌধুরীর সহযোগিতায় আটক করে পুলিশ। ওই দিন রাত ৮টার দিকে বিশেষ অভিযানের কথা বলে মদসহ গ্রেফতারের মিথ্যা মামলা সাজানো হয়। রাত ৯টার দিকে পুলিশ ফোন করে রুবেলকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে। টাকা না দিলে ৫০০ লিটার চোলাই মদ দিয়ে মিথ্যা মামলায় আদালতে চালান দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। পরিবার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে থানায় বসে ২০০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধারের মিথ্যা মামলার এজাহার সাজানো হয়। সেইসঙ্গে ভুয়া জব্দ তালিকা তৈরি করে এক পুলিশ সদস্য বাদী হয়ে বোয়ালখালী থানায় রুবেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন। পরদিন ২৮ জানুয়ারি বোয়ালখালী থানার এসআই রিযাউল জব্বার শারীরিক আঘাতের কথা গোপন রেখে রুবেলকে আদালতে সোপর্দ করেন। পরে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২ ফেব্রুয়ারি রুবেলকে কারাগারে দেখতে যান স্বজনরা। সেদিন তাকে হুইলচেয়ারে করে স্বজনদের সামনে আনা হয়। তখন স্বজনরা রুবেলের কপালে, ডান চোখের ভ্রুয়ে জখম, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, নিস্তেজ অবস্থায় মাথা হেলিয়ে পড়ে আছে অবস্থায় দেখতে পান। এমনকি কথা বলার কোনও শক্তি ছিল না তার।
এর কারণ জানতে চাইলে স্বজনদের তাড়িয়ে দিয়ে কারারক্ষীরা রুবেলকে কারাগারে নিয়ে যান। ৪ ফেব্রুয়ারি আইনজীবীর মাধ্যমে রুবেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতে আবেদন করেন স্বজনরা। আবেদন গ্রহণ করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে আদালতকে জানানোর জন্য জেল সুপারকে নির্দেশ দেন বিচারক। ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় স্থানীয় ইউপি সদস্য প্রদীপ সূত্রধরের মাধ্যমে পুরবী পালিত জানতে পারেন রুবেল মারা গেছেন। তার লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। সেখানে গিয়ে তারা লাশ দেখতে পান।
পুরবী পালিত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রেফতারের সময় রুবেল সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। থানায় এবং কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে। এতে মৃত্যু হয়েছে। আমি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। স্বামী হত্যায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি চাই।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী অজয় ধর বলেন, ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩-এর ১৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে মামলার এজাহারে। আদালত মামলার আবেদন গ্রহণ করেছেন। যাচাই-বাচাই করে পরবর্তীতে শুনানির জন্য রেখেছেন বিচারক। তবে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। মামলায় ১৬ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।’
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আছহাব উদ্দিন বলেন, ‘রুবেলকে চোলাই মদসহ গ্রেফতারের পরদিন আদালতে চালান দেওয়া হয়। তার কাছে যে পরিমাণ মদ পেয়েছি, তা দিয়ে মামলা দেওয়ার পর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। থানায় কোনও ধরনের নির্যাতন কিংবা মারধর করা হয়নি। থানায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। আদালতে নেওয়ার সময় রুবেল সুস্থ ছিল। পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠেছিল। এমনকি আদালতে তোলার দিনেও সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল। এ কারণে হাসপাতালের পরিবর্তে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। কারাগারের নেওয়ার পর ওখানে কী হয়েছে, তা আমরা জানি না।’