নিম্ন জলাভূমি অঞ্চলের মানুষ নিজেদের জীবিকার তাগিদেই ভাসমান সবজি চাষ করে আসছেন বহু বছর ধরে। তবে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক প্রমাণিত হওয়ায় জেলার অন্যান্য এলাকায়ও এই চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। সম্প্রতি কৃষি বিভাগ চাষীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ভাসমান সবজি চাষ দিন দিন বাড়ছে। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের কৃষকেরা কম-বেশি এই ধরনের চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে মিত্রডাঙ্গা, জোয়ারিয়া, পাথরঘাটা, গোপালপুর, বৈন্নাবাড়ী ও তাড়াইল গ্রামের কৃষকের ভাসমান ধাপে চাষাবাদ করে থাকেন।
মূলত বর্ষা মৌসুমে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলে পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ একত্রিত করে কৃষকেরা তিন থেকে পাঁচ ফুট চওড়া এবং সর্বোচ্চ ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের এক-একটি ধাপ তৈরি করেন। শ্রমের মূল্য ছাড়া এই ধাপ তৈরিতে আর কোনও খরচ নেই। নেই সার দেওয়ার বাড়তি ঝামেলা। এমনকি সেচও দিতে হয় কালেভদ্রে। পোকা-মাকড়ের উপদ্রপ ঠেকাতে কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন। ধাপের ওপর পুঁতে দেন গাছের ডাল। সেখানে এসে বসে বিভিন্ন পাখি। এসব পাখিও অনেক পোকাকামড় খেয়ে সাবাড় করে। মূলা, শশা, ঢেরশ, পুঁইশাক, লালশাক, বরবটি, বাঙ্গি, চালকুমড়া, হলুদসহ প্রায় ১৬ রকমের সবজি আবাদ করা হয় এই ধাপ পদ্ধতিতে। এক-একটি কৃষক পরিবার দুই থেকে পাঁচটি ধাপ তৈরি করে সবজি আবাদ করেন। বীজ কেনা এবং আগাছা পরিষ্কারে তাদের গড়ে ধাপ প্রতি তিন হাজার টাকার মতো খরচ হয় বলে জানা গেছে। আর আয় হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
শীত মৌসুমে নভেম্বরের শেষ দিকে পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগে কৃষক ধাপগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে নিজ নিজ জমিতে নিয়ে যান। পানি পুরো শুকিয়ে গেলে ধাপগুলো ভেঙে জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই জমিতে আবাদ করা হয় উচ্ছে, টমেটো, বিভিন্ন ধরনের কপি এবং ব্রকোলির মতো সবজি।
কৃষকেরা জানান, অনেক আগে থেকেই তারা এই ধাপ পদ্ধতিতে চাষবাস করছেন। আগে ধাপগুলো বাঁকা হতো। এখন কৃষি বিভাগের পরামর্শে এগুলো সোজা করে তৈরি করা হচ্ছে এবং স্থায়িত্বও বেড়েছে। এতে কোনও সার লাগে না। কীটনাশক লাগে না। বরং পানি শুকিয়ে গেলে এই ধাপ জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ওলকপি, ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রকলি, উচ্ছে নানান ফসল চাষ করা হচ্ছে।
তারা জানান, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিম্নাঞ্চল। এ এলাকার কৃষকরা ইতোমধ্যে জলবাযু পরিবর্তনজনিত সমস্যা থেকে বাঁচতে কচুরীপানা দিয়ে তৈরি ধাপ বানিয়ে সার ও কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন করছেন। এতে এক দিকে যেমন তাদের উৎপাদিত সবজি জেলার চাহিদা মিটাচ্ছে, আবার অন্যদিকে কৃষকরা এসব সবজি বিক্রি করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন।
গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সমীর কুমার গোস্বামী জানান, ‘গোপালগঞ্জের প্রায় ১৫ হাজার ধাপের ওপর চলছে এ ধরনের চাষাবাদ। আর এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৪/৫ হাজার কৃষক। এ সময়ে নিম্ন জলাভূমি এলাকার মানুষের হাতে কোনও কাজ থাকে না। ধাপের ওপর সবজি চাষ করে তারা জীবিকা চালাচ্ছেন।’
ইউনিসেফ ধাপ চাষাবাদ পদ্ধতিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে বলেও জানান তিনি।