X
রবিবার, ২৬ মার্চ ২০২৩
১২ চৈত্র ১৪২৯

মুন্ডা নৃগোষ্ঠী আজও পরবাসী

হেদায়েৎ হোসেন, খুলনা
০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪৬আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪৬

সুন্দরবনে মাছ ধরা থেকে শুরু করে মাঠে শস্যবীজ রোপণ, ধান কাটা, শাকসবজি চাষসহ—সব কাজে পুরুষের চেয়ে বেশি শ্রম দেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুন্ডা নারীরা। এরপরও মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক। ফলে সবকিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি তাদের। আজও পিছিয়ে আছেন তারা।

খুলনার কয়রার সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীর পাড়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুন্ডাদের বসবাস। আজও পরবাসী হয়ে তাদের বসবাস। নিজস্ব জমি ও স্থান বলতে কিছুই নেই। নদীর পাড়ে কোনও রকমে ঘর তুলে বসবাস করছেন। এই সম্প্রদায়ে পুরুষই সব। নারীরা কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তবু পুরুষের পাশাপাশি কৃষিকাজ, নদীতে মাছ ধরা ও দিনমজুরি সবকিছুই তাদের করতে হয়। বর্তমানে কয়রায় মুন্ডা নারী শ্রমিক আছেন ২৭৯ জন। 

মুন্ডা কারা?

বাংলাদেশে মুন্ডাদের আগমন ও তাদের বসতি বিন্যাসের প্রকৃত তথ্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং উৎখননের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বিহারে ও রাঁচিতে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে তাদের আদি বসতি বিন্যাসের সময়কাল এবং স্থান নিরূপণ করা যায়।

ভারতবর্ষে প্রধানত ১৩টি মুন্ডা জাতিগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ রয়েছে। মুন্ডা দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি। ভারতের ঝাড়খণ্ড ও ছত্রিশগড় রাজ্যের ছোটনাগপুর অঞ্চল, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে তাদের বাস। বাংলাদেশের কোনও কোনও অঞ্চলে বসবাস করেন তারা। কয়রা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বসতি বিন্যাসের এবং সুন্দরবন এলাকায় মুন্ডাদের আদি বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। কয়রা, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে মুন্ডা ও মাহাতোর ৩২২টি পরিবার বসবাস করে। শ্যামনগরে মুন্ডাদের ৪২০ পরিবারে দুই হাজার ৭৪০ জন সদস্য রয়েছেন। এসব পরিবারের ৯৫ শতাংশ ভূমিহীন। 

ভাষা

তারা মুন্ডারি ভাষায় কথা বলেন। যা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এই ভাষা উড়িয়া, অসমীয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়। বাংলা বাগভঙ্গির ওপর মুন্ডা ভাষার প্রভাব আছে। মধ্য প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক কোটি লোক মুন্ডা ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার। তিন-চার হাজার বছর পূর্বে মুন্ডারা পিজিন ভাষা হিসেবে পেশা ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রথম মুন্ডা ভাষা ব্যবহার করেন। এখন সেই ভাষা ভুলতে বসেছে তাদের বর্তমান প্রজন্ম। প্রাথমিক পাঠ শেষে শিশুরা ঝরে যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মুন্ডাদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো—অপ্রতুল স্কুল ব্যবস্থা এবং তাদের নিজস্ব পারিবারিক ও ভাষাগত চর্চায় নিরুৎসাহ করা। তবে বর্তমানে মুন্ডারা বিভিন্ন এনজিও এবং সমাজপতিদের মাধ্যমে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিচর্চা করতে পারছেন না মুন্ডারা।

কয়রার সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীর পাড়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুন্ডাদের বসবাস

পেশা-জীবিকা

আগে তাদের প্রধান জীবিকা ছিল সুন্দরবনে গাছ কাটা, নদীতে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ। বর্তমানে অনেকে আদি পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম করছেন তারা।

কয়রারর পাথরখালী গ্রামে অঞ্জলি মুন্ডার বসবাস। তিনি জানান, কৃষিজমিতে কাজ করে সংসার চলে। নদীর পাড়ে বসবাস করায় যেকোনো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা পেছনের কাতারে থাকেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়ে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পান।

উপজেলার ২ নম্বর কয়রা গ্রামের নিখিল মুন্ডা বলেন, ‘কৃষিজমিতে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতে হচ্ছে। অভাব লেগেই আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হই। পাশাপাশি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পুরুষের অর্ধেক মজুরি পাই। ফলে ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয় না।’

সমান কাজ করে পুরুষের অর্ধেক মজুরি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কয়রার নলপাড়া গ্রামের সন্ধ্যারানী মুন্ডা। তিনি বলেন, ‘সারাদিন অন্যের জমিতে কাজ করি। এজন্য একবেলা খাবার ও ২৫০ টাকা মজুরি পাই। মাঠে পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে সমান কাজ করলেও অর্ধেক মজুরি পাই। স্বামীর আয়ে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের মুন্ডাপাড়ার এক নারী বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে বোরো-আমন মৌসুমে চারা রোপণ, ধান কাটাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসলের পরিচর্যা, মাটিকাটা, চাতাল-ইটভাটায় এবং রাজমিস্ত্রির কাজ করি। ঝড়বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে অনেক কষ্ট করতে হয়। অথচ মজুরি পাই পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক। এটি পরিবর্তন হওয়া উচিত।’

মজুরি বৈষম্যের কথা স্বীকার করে কয়রা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাসিমা আলম বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে কয়রায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে মজুরি বৈষম্য চলছে। নারী শ্রমিকরা সবসময় উপেক্ষিত। সামাজিক সচেতনতাই এই বৈষম্য দূর করতে পারে।’

নদীর পাড়ে কোনও রকমে ঘর তুলে বসবাস করছেন তারা

ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ (আইআরভি)-এর নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যুথী বলেন, ‘এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্য দূর করতে হবে। এজন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারীদের কার্যকর অংশগ্রহণ, মজুরি বৈষম্য দূর, সরকারি প্রণোদনাসমূহে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে।’

কয়রা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেশমা আক্তার বলেন, ‘মুন্ডা নারীরা কঠোর পরিশ্রম করেও পুরুষের সমান মজুরি পান না, এটা খুবই দুঃখজনক।’ 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সরকারি কোনও প্রকল্প এলেই তাদের সহযোগিতা করা হয়।’

/এএম/
বাসায় জেল খাটছেন আসামিরা
৫ বছর মাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরছে কিশোর ছেলে, এগিয়ে এলেন পুলিশ কর্মকর্তা
জেল খেটেছেন, চাকরি হারিয়েছেন, তবু দমে যাননি সাখাওয়াত
সর্বশেষ খবর
জিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে পাকিস্তানিদের দোসর: তথ্যমন্ত্রী
জিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে পাকিস্তানিদের দোসর: তথ্যমন্ত্রী
মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্পিকারের শ্রদ্ধা
মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্পিকারের শ্রদ্ধা
চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে প্রবাসীকে হত্যা
চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে প্রবাসীকে হত্যা
আজকের আবহাওয়া: ২৬ মার্চ ২০২৩
আজকের আবহাওয়া: ২৬ মার্চ ২০২৩
সর্বাধিক পঠিত
৭০ বছর বয়সে বিয়ের কারণ জানালেন সেই কলেজশিক্ষক
৭০ বছর বয়সে বিয়ের কারণ জানালেন সেই কলেজশিক্ষক
বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা ও হ্যান্ডলিং করতে চায় জাপান
বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা ও হ্যান্ডলিং করতে চায় জাপান
শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা নদী হঠাৎ পানিতে টইটম্বুর
শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা নদী হঠাৎ পানিতে টইটম্বুর
পুতিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে বললেন এরদোয়ান
পুতিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে বললেন এরদোয়ান
ওসি হারুন এতো সহজে হারে না: ‘মহানগর ২’
ওসি হারুন এতো সহজে হারে না: ‘মহানগর ২’