X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেভাবে জাতীয় দলে এলেন কলসিন্দুরের ৮ তারকা

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২:২৮আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪০

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের ৮ ফুটবল খেলোয়াড় এখন জাতীয় দলে। গতকাল নেপালের সঙ্গে ফাইনালে জিতে তারা ছিনিয়ে এনেছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি। ধাপে ধাপে তারা জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক বাধা আর সংগ্রাম।

জাতীয় দলকে সগৌরবে প্রতিনিধিত্ব করা আট ফুটবলার হলেন সানজিদা, মারিয়া, শিউলি আজিম, মারজিয়া আক্তার, শামসুন্নাহার, তহুরা, সাজেদা ও শামসুন্নাহার জুনিয়র।

২০১১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে খেলায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই তাদের হাতেখড়ি। তখন তারা কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওই সময় কেউ তৃতীয় শ্রেণিতে, কেউবা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল, সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিন এবং একই এলাকার ফুটবলার জুয়েল মিয়া তাদের খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করতে কাজ শুরু করেন। ২০১১ ও ২০১২ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে এই ফুটবল-কন্যারা চ্যাম্পিয়ন হলেও জাতীয় পর্যায়ে যেতে পারেননি। তবে পরের বছর ২০১৩ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি তারা ঠিকই ঘরে তোলেন।

শুরুতে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পারিবারিক নানা বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল উঠতি প্রমিলাদের। ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়াটা তাই দুরূহ ছিল তাদের জন্য। তবে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই সেসব বাধা আস্তে আস্তে দূর হতে শুরু করে।

স্মৃতিচারণা করে কলসিন্দুর ফুটবল দলের কোচ জুয়েল মিয়া বলেন, ‘শুরুতে মেয়েদের জন্য ফুটবল খেলাটা ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিশেষ করে মেয়েরা হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে ফুটবল খেলবে, এটা স্থানীয় লোকজন কোনওভাবেই মানতে পারেনি। এর প্রভাব পড়েছিল প্রতিটি মেয়ের পরিবারে। একসময় স্কুলের ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে তাদের বাধা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু মেয়েরা ফুটবলকে ভালোবাসতে শুরু করে। তাই পরিবারকে না জানিয়ে অনেক সময় স্কুলে এসে ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ নিত। খেলার প্রতি তাদের সেই আগ্রহ ও মনোবলই আজকের এই সাফল্যের মূল কারণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে প্রথম জাতীয় দলে জায়গা পায় তাসলিমা ও মারজিয়া। এরপর বাকিরা জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ধাপে ধাপে তারা আট ফুটবলার জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়। তারপর থেকেই বদলে যেতে থাকে গ্রামের চিত্র।’

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল বলেন, ‘এই মেয়েদের তৈরি করতে অনেক শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তাদের পরিবার সম্পূর্ণভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। গরিব হওয়ায় এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে পরিবারের সদস্যরা মেয়েদের খেলার প্রতি আগ্রহী ছিল না। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে মেয়েদের ফুটবল খেলায় প্রস্তুত করা হয়। তবে মেয়েদের আগ্রহ ও মনোবল ছিল খুবই সুদৃঢ়। তাই আজ তারা দেশের হয়ে ইতিহাস গড়েছে।’

একদিকে সমাজের রক্ষণশীলতা, অন্যদিকে অভাব-অনটন, কলসিন্দুরের কৃষিনির্ভরশীল পরিবারের মা-বাবারা অনেক সময় চাইলে পারেননি মেয়েদের সম্মতি দিতে। আবার অনেক মা-বাবা সব উপেক্ষা করে মেয়ের আবদারকেই দিয়েছেন প্রাধান্য।

সাফজয়ী ফুটবলার সানজিদার বাবা লিয়াকত আলী তেমনটাই জানান। তিনি বলেন, ‘আমার ছয় সন্তানের মধ্যে সানজিদা তৃতীয়। প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সানজিদা ফুটবল খেলা শুরু করে। মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলবে, মানুষ কী মনে করবে, এই চিন্তা থেকেই আমাদের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না যে সে ফুটবল খেলুক। স্কুলের মফিজ উদ্দিন স্যার জোর করেই সানজিদারে ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়ায়। আস্তে আস্তে আমার মেয়েসহ অন্য মেয়েরা খেলায় ভালো করতে থাকল। তখনই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে।’

সাফজয়ী মারিয়া মান্দার মা এনোতা মান্দা বলেন, ‘মারিয়া ফুটবল খেলুক, এটা আমরা পরিবার থেকে চাইতাম। কিন্তু আশপাশের মানুষ মেয়েদের ফুটবল খেলাকে পছন্দ করত না এবং তারা খেলতে যাওয়ায় বাধা সৃষ্টি করত। পলাইয়া স্কুলের মাঠে গিয়ে মারিয়া ফুটবল খেলার প্র্যাকটিসে অংশ নিত। এভাবে নানা বাধা পেরিয়ে আজকে তারা সাফল্যের মুখ দেখেছে এবং বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’

মেয়ে মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে ফুটবল খেলবে, এটা কেউ পছন্দ করে না উল্লেখ করে শামসুন্নাহার জুনিয়রের বাবা নেকবর আলী বলেন, ‘গরিব ঘরের সন্তান হওয়ায় মেয়েকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার অবস্থা আমার ছিল না। মফিজ স্যার, মালাদি এবং জুয়েল স্যার আশপাশের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহায়তা নিয়ে খেলা চালিয়ে গেছে মেয়ে। আজ আমাদের ৮ মেয়ে জাতীয় দলে জায়গা পাইছে অনেক লড়াই ও সংগ্রামের মাধ্যমে। তারা দেশের জন্য ট্রফি ছিনিয়ে এনেছে। তাদের সাফল্যে শুধু আমরা না, ধোবাউড়াবাসী গর্বিত।’

/এনএআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!