আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়েছে কুষ্টিয়ার ৫ হাজারের বেশি বুটিক কারিগরের। জর্জেট ও সিল্কের থান কাপড়ের ওপর পুঁতি, পাথর ও চুমকি বসিয়ে তারা তৈরি করছেন নানা ডিজাইনের বাহারি শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের দম ফেলার ফুরসত নেই। ঈদের বাজার ধরতে দিন-রাত সমানে কাজ করে চলেছেন তারা।
মানের দিক থেকে উন্নত এখানকার নকশি পণ্য ইতিমধ্যে ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরের বাজার দখল করেছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশেও এসব হস্তশিল্পীদের কাজ করা শাড়ির চাহিদা বাড়ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অভিজাত বিপণিগুলোতে এসব শাড়ি বিক্রি হতে দেখা যায়। আর ঈদের আগে বাড়তি চাহিদা মেটাতে এখন দিনরাত কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে এসব বুটিকস শিল্পীদের। গ্রামের নিভৃত পল্লীতে বাহারি ডিজাইনের কাপড় তৈরি হলেও তারা প্রতিযোগিতায় নামছে ভারতসহ অন্যান্য দেশের দামি কাপড়ের সঙ্গে।
সূত্রমতে, স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় প্রায় একযুগ আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালী-খোকসা এবং এর আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে ওঠে বেশ কিছু হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান। এখন সেটির সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতাধিক।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কুমারখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ঘরের মেঝেতে কাঠের পাটাতনে শাড়ির চার কোনায় বেঁধে বাহারি রঙের পাথর বসিয়ে বুটিকস কারিগরা তৈরি করছেন নান্দনিক ও মুগ্ধকর নকশা। এখানে মেশিনে কোনও কাজ করা হয় না। গ্রাহক বা শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের পছন্দ মতো শাড়ি এনে দেন। তারপর বুটিকস কারিগররা শুধু ক্যাটালগ দেখে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশা ও পাথর বসিয়ে কাজ শেষ করেন।
নকশার কাজে ওয়েট লেইস, মাখন, লেদার জর্জেট, পাথর, জরি, চুমকি, মাল্টি পুঁতি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এরপর কাপড় ও কাজের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। এখানে শাড়ির দাম নির্ধারণ হয় ডিজাইন ভেদে। এবারের ঈদে বেশি চাহিদা পার্টি শাড়ি ও লেহেঙ্গা শাড়ির। ছুফিয়ান, নেট, শিপন ও লেক্সমি কাপড়ের ওপর বিভিন্ন ডিজাইনে প্রতিটি শাড়ির দাম ৪ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বুটিকস কারিগররা জানান, পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা পদ্ধতিতে তারা কাজ করেন। একটি শাড়িতে পাথরের কাজ করতে ৩/৪ জন শ্রমিকের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে। একটি কাপড়ে ডিজাইন করে একজন বুটিকস কারিগর পান ১ থেকে ৩ হাজার টাকা। নিজ বাড়িতে বসেই তারা তৈরি করতে পারেন এসব ডিজাইন। অধিকাংশ নারী বাড়িতে কজ করে কারখানায় জমা দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে যান। মাসে তাদের আয় হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা।
কুমারখালী উপজেলার বুটিকস কারিগর মর্জিনা খাতুন জানান, ঈদকে সামনে রেখে ৬ মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়েছে। গ্রাহকরা কাপড় দিয়ে অর্ডার দিয়ে যান। রোজার প্রথম সপ্তাহের পর আর অর্ডার নেওয়া হয় না। এক সময়ে গ্রাম্য নারীরা রান্নার কাজ আর সন্তান লালন পালন ছাড়া অন্য কোনও কাজ করতেন না। সময় পেলে শখের বশে নকশিকাঁথা, বালিশের কাভারে ফুল আঁকাসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। কিন্তু গ্রাম্য এসব নারীর মানসিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বেশ বদলে গেছে এখানকার নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। হস্তশিল্পের বর্ণিল আভায় আলোকিত এখন এখানকার বিভিন্ন জনপদ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের বেকার যুবক-যুবতী ও গৃহবধূরাও ঝুঁকছেন হস্তশিল্পের দিকে। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষিত হয়ে বাড়িতে ও কারখানায় কাজ করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন। শুধু তাই নই, অভাবী সংসারে জন্ম নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী এ কাজ করে পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন। যা এলাকায় বাল্যবিবাহ রোধ করছে অনেক। নারীদের পাশাপাশি এ কাজের জন্য পুরুষরাও এখন এগিয়ে আসছেন।
বর্তমানে কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় ব্যক্তি প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে শতাধিক হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান। সম্ভাবনাময় এসব হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে ৫ সহস্রাধিক নারী প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি এখন আত্মনির্ভরশীল।
খোকসার বুটিকস কারিগর বিউটি খাতুন জানান, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনমজুর স্বামী পরান মন্ডলের সামান্য উপার্জনে তাদের পরিবারে দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। পরে জর্জেট, সিল্কের থান কাপড়ের ওপর পাথর, চুমকি ও পুঁতি বসানো কাজ শুরু করি।
স্থানীয় সোনালী হস্তশিল্পের পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, তার কারখানায় প্রায় ৯শ’ নারী শ্রমিক কাজ করছেন। দেশি কাপড়ের বাজার যখন বিদেশি কাপড় আর ডিজাইনের দাপটে হিমশিম খাচ্ছে তখন কুষ্টিয়ার এই হস্তশিল্প মনে করিয়ে দেয় দেশীয় ঐতিহ্যের কথা। এসব পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা বাজারজাত করছেন। ঈদকে সামনে রেখে তাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে।
কুমারখালী হস্তশিল্পের পরিচালক রিনা আহসান জানান, একজন দক্ষ প্রশিক্ষিত নারী মাসে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। হাতের কাজ করা এসব শাড়ি মানসম্পন্ন হওয়ায় ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বাহারি লেইস বাজারে আসার কারণে তাদের ব্যবসায় মন্দার সৃষ্টি করেছে। এটা এ ব্যবসার জন্য হুমকি। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
/এসএনএইচ/