কানাডা থেকে নিখোঁজ সন্দেহভাজন জঙ্গি তামিম আহমদ চৌধুরীর খোঁজ চলছে অনেকদিন ধরে। গুলশান-শোলাকিয়ায় হামলা থেকে শুরু করে অনেকগুলো জঙ্গি হামলায় তার নাম উঠে এসেছে। কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায়ও তার আসা-যাওয়া ছিল বলে দাবি করেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তাকে ধরিয়ে দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
তামিম চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান কোথায়, স্বজনদের সঙ্গে তার কোনও ধরনের যোগাযোগ রয়েছে কিনা, তাকে কোথাও দেখা গেছে কিনা সেব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলা ট্রিবিউন।
তামিমের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে গত বুধবার (১৭ আগস্ট) বাংলা ট্রিবিউনের সিলেট প্রতিনিধি সরেজমিনে বিয়ানীবাজার যান। ভারত সীমান্তঘেঁষা তামিমদের গ্রামের বাড়ি বড়গ্রাম। সিলেট থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৪৪ কিলোমিটার। গ্রামের পূর্ব পাশেই সুতারকান্দি বর্ডারের অবস্থান। তামিমদের বাড়ি থেকে মাত্র ৩শ’ গজ দূরে ওপারে ভারতের সূতারকান্দি দেখা যায়। এলাকাবাসী তামিমের বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য জানাতে পারেননি। এমনকি তার তিন চাচার বাড়িঘরও তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, ‘আমার লগ (সঙ্গ) ছাড়ি দেও, আমি আল্লাহর নামে আছি’ —পাঁচ বছর আগে বাবাকে এই চিঠি পাঠিয়ে তামিম আহমদ চৌধুরী নিখোঁজ হন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের দুবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম। এরপর পরিবারের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই বলেই জানেন এলাকার লোকজন।
বাংলা ট্রিবিউনর সঙ্গে আলাপকালে তামিমের বাবার চাচাতো ভাই,পাশের বাড়ির হুমায়ুন কবির জানান, শফিকুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে সোয়া মিয়া ব্রিটিশ শিপের ডিজেল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ডে। স্বাধীনতার আগে কিংবা তার কিছুদিন পরেই তিনি কোম্পানির মাধ্যমে কানাডায় চলে যান। এরপর তার (সোয়া মিয়া) সঙ্গে তার চাচাতো ভাইয়ের কোনওদিন ফোনেও যোগাযোগ হয়নি বলে দাবি করেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, কানাডায় যাওয়ার পর সোয়া মিয়া বিয়ে করেন। বউকে নিয়ে তিনি একরাতও গ্রামের বাড়িতে থাকেননি। তিনি এও জানান,উচ্চ শিক্ষিত সোয়া মিয়া শুরু থেকেই কিছুটা একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলেন। আগে থেকেই তিনি কিছুটা অন্তর্মূখি ছিলেন, সবার সঙ্গে মিশতেন না। বিয়ের পর থেকে গ্রামের লোকজন তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ কমে যায়।
হুমায়ুন কবির জানান,তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ৭ বছর কাতারের রাজধানী দোহায় ছিলেন। এরপর তিনি সৌদি আরবে চলে যান। এর মধ্যে সোয়া মিয়ার সঙ্গে তার কোনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তার জানা মতে, সোয়া মিয়ার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তার (সোয়া মিয়া) বড় ভাই ফখরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে জামিলের সঙ্গে। জামিল স্ত্রীকে নিয়ে সপরিবারে কানাডায় থাকেন। তবে, জামিলের এবং সোয়া মিয়ার পরিবার সেখানে আলাদা আলাদা বসবাস করেন বলেও তিনি জানান।
কানাডায় যোগাযোগের কোনও নম্বর আছে কিনা জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী তামিমের বড় ফুফু ময়ুর বেগমের বরাত দিয়ে তিনি জানান, এমনিতে গ্রামের সঙ্গে সোয়া মিয়ার পরিবারের যোগাযোগ কম ছিল, ছেলে হারানোর পর থেকে তিনি (সোয়া মিয়া) পরিবারের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করছেন না।
তামিমের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি মিডিয়ায় আসার পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাদের বাড়িতে যাতায়াত করছে বলেও জানান হুমায়ুন কবির। কী কারণে তামিম জঙ্গি তৎপরতায় জড়ালো-এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি তার চাচা হুমায়ুন কবির।
সোয়া মিয়ার আট ভাই-বোন রয়েছে। এর মধ্যে বোন চারজন ও ভাই চারজন। তার বড় ভাই ফখরুল ইসলাম চৌধুরী মারা গেছেন ৪/৫ বছর আগে। তার ছেলে জামিলের সঙ্গে সোয়া মিয়ার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। সোয়া মিয়া দ্বিতীয়। তৃতীয় ভাই নজরুল ইসলাম চৌধুরী ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে নগরীর পার্ক ভিউ মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন আছেন। চতুর্থ ভাই নূরুল এমরান গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
তামিমদের গ্রামের বাড়ি তালাবদ্ধ থাকা সম্পর্কে হুমায়ুন কবিরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তাদের বড় ভাই মারা গেছেন। নজরুল ইসলাম গত কয়েক মাস ধরে শয্যাশায়ী। নূরুল এমরান ব্যবসার কারণে বাড়ির বাইরে অবস্থান করেন। এ কারণে বাড়িটি তালাবদ্ধ আছে। তামিমের বা অন্য কোনও কারণে বাড়িটি তালাবদ্ধ কিনা এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন।
তামিমদের বাড়িতে দু’টি টিনশেডের ঘর রয়েছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে এ দু’টি ঘরের অবস্থান। বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ঘর সম্ভবত গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ঘরের লাগোয়া একটি খালি প্লট রয়েছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ওই বাড়ি পরিদর্শনে যাওয়া বিয়ানীবাজারের সাংবাদিক সাদেক আহমদ আজাদ জানান, খালি প্লটটিও তামিমদের। তবে এ বিষয়ে হুমায়ুন কবিরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, বাড়িটি এখনও ভাগ-বাটোয়ারা হয়নি। বাড়িতে বিশাল আকৃতির একটি পুকুরও রয়েছে।
সিলেট থেকে মোটামুটি সড়ক পথে সেখানে যাওয়া যায়।তামিমদের বাড়িতে যেতে আধা কিলোমিটার জায়গা পায়ে হাঁটতে হয়।
একই গ্রামের বাসিন্দা কৌশিক রঞ্জন দাসকে তামিমের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, ‘ভাই, আমরা ঘুম থাকি উঠিয়া বন্দও ক্ষেতের মাঠ যাই। জঙ্গি-টঙ্গির বিষয়ে আমরার খোঁজ রাখার সময় নাই। তবে তামিমরে লইয়া সব খানও বেশ আলোচনা অর। ই গ্রাম অত বড় জঙ্গির জন্ম অইছে-ইটা নিয়ে মানুষকে মাতামাতি করইন।’
দুবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও একই গ্রামের বাসিন্দা জাকারিয়া আহমদ জানান, ‘তামিমের কর্মকাণ্ডকে আমরা ঘৃণা করি। তাকে গ্রেফতার করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’ তামিমের ছোট চাচা নূরুল এমরান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বলেও তিনি জানান।
দুবাগ ইউনিয়নের দুই দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, তামিম বিয়ানীবাজারে নেই। সে এলাকায় এলে আমরা তাকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেবো। তিনি বলেন, তামিমের বিষয়ে প্রায়ই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তিনি এও বলেন, এই পরিবারের সদস্যদের এ রকম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, কেন যে এমন হলো-তা বুঝে উঠা যাচ্ছে না।
বিয়ানীবাজার থানার ওসি চন্দন চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মূলত শুরু থেকেই পুলিশ তামিমের জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে তৎপর রয়েছে। তবে, সে সিলেটে কিংবা বিয়ানীবাজারে আসে না-এটা নিশ্চিত। তার চাচারাও তাকে দেখেনি বলে আমাকে জানিয়েছেন। এরপরও তার বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মিডিয়া অফিসার সুজ্ঞান চাকমা জানান, তামিমকে গ্রেফতারের বিষয়ে পুরো দেশের পুলিশ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটও রয়েছে। তিনি বলেন, জঙ্গিদের বিষয়ে সিলেট পুলিশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে অনেক কিছুই বলা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিয়ানীবাজার থানা পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, তামিমের পিতা শফিকুর রহমান চৌধুরী ওরফে সোয়া মিয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কানাডায় পাড়ি জমান। এরপর তিনি সেখানে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে পরিবারের সঙ্গে সোয়া মিয়ার যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে তার স্বজনেরা জানিয়েছেন।
তামিমের চাচাতো ভাই ফাহিম আহমদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে এর আগে জানিয়েছিলেন, তামিম ভাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। সম্ভবত ১৯৯৫ সালে তিনি একবার গ্রামের বাড়িতে এলে দেখা হয়। তবে আমি ছিলাম অনেক ছোট। তখন তামিম ভাইয়ের বয়স ছিল আনুমানিক ১৪-১৫ বছর। এরপর থেকে আর তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।
তামিমের আরেক চাচাতো ভাই তাজিন আহমদ চৌধুরী বিয়ানীবাজারের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২০০১ সালে তারা সপরিবারে বাংলাদেশে এলেও গ্রামের বাড়িতে একবারের জন্যও আসেননি। সিলেট নগরীতে বাসা ভাড়া করে প্রায় ৩ মাস থাকার পর তারা আবার ফিরে যান কানাডায়।
স্বজনরা জানান, ব্যক্তিগত জীবনে তামিম বিবাহিত এবং ৩ সন্তানের জনক। তারা ১ ভাই ও ১ বোন। ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ায় তামিমের নানার বাড়ি।
তামিম কবে থেকে নিখোঁজ এ সংক্রান্ত কোনও তথ্য জানা যায়নি। তবে র্যাব জানিয়েছে তার পাসপোর্ট নম্বর-এএফ-২৮৩৭০৭৬ ইস্যু-০৪/০৮/২০১৩, মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ: ০৩/০৮/২০১৬ পুরাতন পাসপোর্ট নং- এল ০৬৩৩৪৭৮ জম্ম নিবন্ধন নং: ১৯৮৬০০৯১২৪১০০১৩৪২।
দেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর পর পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তামিমকে এসবের পেছনে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে সন্দেহ করছে এবং সে দেশেই আছে বলে দাবি করেছে।
আরও পড়ুন-
মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়, কিস্তি না দেওয়ায় সাঈদীর প্লট বাতিল
অনেক অভিযোগ, তবু আমলে নিচ্ছে না বিএনপির হাই কমান্ড
/এফএস/ এমএসএম/