X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলির জন্য কান্না

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ০২:১৭আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:০৮

আকতার-জাহান

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরে গেছেন। এমন সময়ে প্রিয় শিক্ষক আকতার জাহান জলির মৃত্যুতে তাদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা প্রিয় ‘ম্যাডামকে’ ঘিরে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শোকবার্তা, বেদনা আর কান্না মেশানো বার্তায় স্মরণ করছেন তাদের প্রিয় ম্যাডামকে।

পোস্টদাতাদের একজন হলেন মেহেরুল হাসান সুজন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পরীক্ষার হলে যতোবারই ম্যাডাম পরিদর্শক হিসেবে থাকতেন, অতিরিক্ত খাতা আনতে গেলেই বলতেন, ‘ মেহেরুল, তুমি যেন এখন কোন কাগজে কাজ করছো?’ আমি হাসিমুখে বলতাম। উত্তর শুনে ম্যাডাম হেসে বলতেন, ‘ও, ভুলে যাই শুধু।’

তিনি আরও লেখেন, ‘থার্ড ইয়ারে ম্যাডাম রিপোর্টিং কোর্স পড়াতেন আমাদের। একদিন ম্যাডাম ডেথ রিপোর্টিং পড়াচ্ছিলেন। আমি তখন ব্যাক বেঞ্চে কারও সঙ্গে দুষ্টুমি করে হাসাহাসি করছিলাম। ম্যাডাম টের পেয়ে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘আমি ডেথ রিপোর্টিং পড়াচ্ছি, আর তুমি হাসছো!’ আমি বললাম, ‘ম্যাডাম, হাসছি না তো। আমার তো স্মাইলিং ফেস, তাই আপনার হয়তো অমন মনে হয়েছে।’ ম্যাডাম বললেন, ‘ক্লাসে মনোযোগ নেই, ভাইভাতে গিয়ে তো চুপ করে থাকবে। কোনো কিছুর উত্তর দিতে পারবে না। তখন দেখবো তোমার স্মাইলিং ফেস।’

তিনি আরও লেখেন, ‘এমন অসংখ্য স্মৃতি আকতার জাহান ম্যাডামের সঙ্গে। কয়েক মাস আগেও আমাকে ফোন করে আমাদের বন্ধু ওয়াহিদা সিফাতের হত্যা মামলার খোঁজখবর নিলেন ম্যাডাম। আর এখন তার অপমৃত্যুর খবর নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আমার রাজশাহীর সহকর্মীরা।’

আকতার জাহানের মাস্টার্সের আরেক ছাত্র মাহবুব আলম লিখেছেন, ‘আপনি তো অনেক যত্ন করেই রিপোর্টিং শেখাতেন ম্যাম। তারপরও কেন আজ আপনার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে হাতটা কাঁপছিল, কেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল? রিপোর্টিং শিখিয়ে কী আজ সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা নিলেন আপনি?’

মাহবুব আরও লেখেন, ‘পরীক্ষার হলে তো এসে বলতেন, 'মাহবুব, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’ আজ কেন জিজ্ঞেস করলেন না ম্যাম? কেন শিখিয়ে গেলেন না ‘মানসিক চাপ’ কতটা হলে একজন মানুষ ‘আত্মহত্যা’ করতে পারে? সেই মানসিক চাপটা কিভাবে বর্ণনা করতে হয়?

আরেক ছাত্র ও টিভি সাংবাদিক রমজান আলী লিখেছেন, ‘উনি তো বলেছেন কেউ দায়ী না। আমাদের তো নিশ্চিন্ত থাকার কথা! কেন এতো ভাবতে যাচ্ছি, ঠিক হয়েছে কি হয়নি। যারা ভালো থাকার তারা ভালো থাকুক। সবাই ভালোবাসত বলেই সবচেয়ে নির্মম সংবাদটা আমাদের লিখতে হলো। জীবনে যেন আর এমন সংবাদ লিখতে না হয়।’

সাবেক ছাত্র সোহেল রানা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মেনে নেওয়া যায়নি... সত্যি কষ্টকর সংবাদ! কেন এমন হচ্ছে!’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষক তানভির আহমদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার করেন আকতার জাহান। ২০১২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ওই আবাসিক ভবনে (জুবেরি) একাই থাকতেন আকতার জাহান। তাদের সংসারে একটি ছেলে (সোয়াদ) রয়েছে। সে ঢাকায় নানির বাড়ি থেকে পড়াশোনা করে।

৬ সেপ্টেম্বর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করার জন্য রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাওয়া কথা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহানের। কিন্তু ঢাকায় যাননি তিনি।  ক্যাম্পাসে এক সময়ের প্রতিবেশী ও ভূতত্ত্ব-খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক গোলাম সাব্বির সাত্তার তপু বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানান।

গোলাম সাব্বির তপুই প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও চেয়ারম্যানকে আকতার জাহানের খবর নিতে বলেন। কারণ আকতার জাহানের ছেলে সোয়াদ শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গোলাম সাব্বির সাত্তার তপুকে বলেছিল, ‘আমার আম্মুর মোবাইলে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। একটু দেখেন।’ তাপু বলেন, ‘তখন আমি নিজেও মোবাইলে তার খোঁজ না পেয়ে সবাইকে জানাতে চেষ্টা করি।’

বিকাল ৪টায় রাবির প্রক্টর মজিবুল হক আজাদ খানের মাধ্যমে খবর পান রাজশাহী নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। দরজা ভেঙে ঘরের বিছানার ওপর মশারির মধ্যে পড়ে থাকা অবস্থায় আকতার জাহানের নিথর দেহ পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসক দ্রুত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিতে বলেন। রামেকের চিকিৎসকরা আকতার জাহানকে মৃত ঘোষণা করেন।’

রাত সাড়ে ১১টায় ওসি আরও বলেন, ‘জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষের বাথরুম থেকে তরল জাতীয় সাদা পদার্থের বোতল, ল্যাপট্যাপ ও মোবাইল উদ্ধার করা হয়। এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। তবে ঢাকা থেকে আকতার জাহানের ভাই ও দুলাভাই রওনা হয়েছেন।’ 

জুবেরী ভবনের ৩৩২টি কক্ষ রয়েছে। এসবের মধ্যে ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষের প্রহরায় দুইজন পুলিশ রয়েছেন।

ভবনটির নিরাপত্তাপ্রহরী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় আমাদের ভবনে আগে হয়নি। খুব খারাপ লাগছে।’

আকতার জাহানের সহকর্মী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহ হিল বাকী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ম্যাডামের ৫ সেপ্টেম্বর শেষ দেখা হয়েছিল। ওই আমাদের মিটিং ছিল। তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকায় যাব, এজন্য ঘরে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ গোছাতে হবে। আমি আর মিটিং থাকতে পারছি না।’ এই বলে চলে গিয়েছিলেন। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর তার ছেলের ( সোয়াদ) সঙ্গে শেষ কথা হয় ম্যাডামের। পরে সোয়াদ তার মাকে ফোন দিতেন, কিন্ত তিনি রিসিভ করতে না। এই দুই দিনের মধ্যে ম্যাডামের কী যে হলো তা আমাদের কাছে রহস্য থেকে যাচ্ছে।’

শিক্ষক আব্দুল্লাহ হিল বাকী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ম্যাডামের ব্যাকপেইন ছিল। এছাড়া কোনও রোগের কথা জানা নেই। ছিল না। ২০১২ সঙ্গে তানভীর স্যারের সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়েছিল। এরপর ম্যাডামের সঙ্গে কথা হলে তিনি আমাকে বলতেন, ‘ছেলেটা ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না। তাকে অবহেলা করে ওরা (তানভীর ও সোমা দেব)। ছেলেটার গরুর মাংস পছন্দ। কিন্তু সেটাও সে খেতে পায় না।’ দাম্পত্য জীবনে তাকে নির্যাতনের কথাও শুনিয়েছিলেন আকতার জানান।

শিক্ষক আব্দুল্লাহ হিল বাকী আরও বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তার ছেলেও আকতার জাহানের মায়ের কাছে থাকতো। তানভীর স্যারের ব্যাপারেও তেমন কিছু বলতো না। তাহলে কী কারণে এমন ঘটনা ঘটলো। তার বুঝতে পারছি না। ম্যাডাম ছিলেন শক্ত মনের মানুষ।

মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘অন্য কোনও ঘটনার আলামত ঘরের মধ্যে প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায়নি। কারণ বাহির থেকে কোনও আক্রমণ হলে ঘর তছনছ হয়ে থাকতো। কিন্তু তিনি তো মশারি টাঙনো বিছানায় পড়ে ছিলেন। ময়নাতদন্ত করলে বোঝা যাবে আত্মহত্যা, না অন্য কিছু ঘটেছে।

লাশ বর্তমানে রামেক হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। চিকিৎসক মহিনুল ইসলাম জানান, ‘শিক্ষিকা আকতার জাহানের মুখে লালা ছিল। ঠোটগুলোও কালো হয়ে গেছে। কেমিক্যাল জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্তের পর শিক্ষিকার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’

এর আগে শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে আকতার জাহানের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পড়ুন: ‘যে সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে, সে মেরেও ফেলতে পারে’

পড়ুন: রাবি শিক্ষকের ‘সুইসাইড নোট’

পড়ুন: রাবি শিক্ষকের লাশ উদ্ধার 

/এইচকে/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে ১২ দলীয় জোট
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
এমন গরমেও ক্লাস করেছে শিক্ষার্থীরা (ফটোস্টোরি)
এমন গরমেও ক্লাস করেছে শিক্ষার্থীরা (ফটোস্টোরি)
উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের শেষ উৎসাহ দূর হবে: ওয়ার্কার্স পার্টির অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের শেষ উৎসাহ দূর হবে: ওয়ার্কার্স পার্টির অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ