X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মকর্তারা পান উপহার, টাকার বিনিময়ে মেলে ইলিশ শিকারের অনুমতি!

আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম
১৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:০০আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৪১

৭০০ টাকার টোকেন নিয়ে মিলছে মা ইলিশ শিকারের অনুমতি (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

কুড়িগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে মা ইলিশ শিকার। ১০ দিন ধরে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলা, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী কয়েকটি ইউনিয়নে এগুলো বিক্রি হচ্ছে দেদার। 

হতবাক করার মতো ব্যাপার হলো, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সম্মতি নিয়েই মা ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা! ৭০০ টাকার টোকেনের বিনিময়ে মিলছে এই সুযোগ। সেই সঙ্গে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে উপহার দিতে হচ্ছে বড় আকারের ইলিশ।
সরেজমিনে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাট ও উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতা ও পাইকাররা এসে মা ইলিশ কিনে নিচ্ছেন। মোল্লারহাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সন্ধ্যা নামতেই জেলেরা নদীতে ইলিশ শিকার করে নৌকায় করে তীরে নিয়ে আসছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতা ও মাঝিরা ইলিশগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আকার ভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়। 

কুড়িগ্রামে মা ইলিশ শিকার ও বিক্রি হচ্ছে দেদার (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন) নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মৌখিক অনুমতি নিয়েই চলছে মা ইলিশ শিকার। আরও কয়েকটি ইউনিয়নে মা ইলিশ শিকারের অনুমতি দিয়েছেন সেইসব স্থানের চেয়ারম্যানরা। তারা স্থানীয় প্রশাসনকে হাতে রেখে নির্বিঘ্নে ইলিশ শিকারে সহযোগিতা করছেন বলে জেলেরাই নিশ্চিত করেছেন। এ কারণে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে ইলিশ উপহার দিতে হচ্ছে জেলেদের।

ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও এ অঞ্চলের জেলেদের কোনও ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়নি। জীবিকার তাগিদে এই অবৈধ পন্থা বেছে নিতে হয়েছে বলে দাবি জেলেদের।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চর এলাকার জেলে নূরনবী জানান, মা ইলিশ শিকার বন্ধের ঘোষণা শুনলেও তিনি কোনও সরকারি সহায়তা পাননি। কিন্তু মাছ শিকার করা ছাড়া তাদের উপার্জনের আর কোনও পথ নেই। তার ভাষ্য, ‘এমনিতে বন্যার সময় কাজের অভাবে রোজগার করতে পারি নাই, মাছ না ধরলে খামু কী?’

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন মা ইলিশ ধরার অনুমতি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের জেলেরা বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় তাদেরকে কোনও সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়নি। অভাবের তাড়নায় তারা মা ইলিশ ধরে বিক্রি করছে। আর তাদেরকে অনুমতি দিয়েছি যেন অন্য ইউনিয়নের জেলেরা আমাদের ইউনিয়নের এসে মাছ শিকার করতে না পারে। তবে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন নদী পরিষ্কার রাখা হয়েছে। রবিবার (১৫ অক্টোবর) থেকে আর কোনও ইলিশ শিকার হচ্ছে না।’

টাকার বিনিময়ে ইলিশ শিকারের অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বেলাল বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ভারতীয় সীমান্তবর্তী মশালের চর এলাকায় সীমান্ত ঘেঁষে ইলিশ ধরা হচ্ছে। এসব ইলিশ না ধরলে তা এমনিতেই ভারতে চলে যাবে। ওপারে ভারতীয় জেলেরা অবাধে আমাদের ইলিশই শিকার করছে। আমার এলাকার অভাবী জেলেরা যদি সেগুলো শিকার করে কিছু টাকা রোজগার করে তাতে ক্ষতি কী।’

এদিকে চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নসহ ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী কয়েকটি ইউনিয়নে অবাধে মা ইলিশ শিকার ও বিক্রি চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরপর মা ইলিশ শিকার ও বিক্রি বেড়ে যায় বলে জানান সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন ক্রেতা এই প্রতিবেদককে জানান, জেলেদের ফোন দিয়ে যে পরিমাণ ইলিশ চাইবেন তারা পুরোটাই সরবরাহ করবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ পুলিশও বিষয়টি জানে। কিন্তু তারা কোনও ব্যবস্থা নেন না।’

রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনজুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ অঞ্চলের জেলেদের তালিকাভুক্তির কার্ড করা হলেও তারা কোনও সরকারি সহায়তা পাননি। এ কারণে অভাবের তাড়নায় তারা মা ইলিশ শিকার করছেন। তার দাবি, সরকারি সহায়তা পেলে জেলেরা হয়তো এই কাজ করতেন না।

কুড়িগ্রামে মা ইলিশ শিকার ও বিক্রি হচ্ছে দেদার (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার হাটবাজারে এই চিত্র দেখা গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ময়নুল ইসলাম জানান, জেলেদের মা ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, হাতিয়া ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ইলিশ শিকারের খবর স্বীকার করেছেন উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম। তার ভাষ্য, ‘আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এ পর্যন্ত দুইশ কেজি ইলিশ ও ৫০ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়েছে।’

উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, উপজেলার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ইউনিয়নগুলোতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে জব্দ জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ও জব্দ ইলিশ এতিমখানায় দান করা হয়েছে। তার কথায়, ‘অভিযান পরিচালনা করতে গেলে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে জেলেরা পালিয়ে যায়। এ কারণে কোনও জেলেকে এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

চিলমারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বদরুজ্জামান মিয়া জানান, অভিযান চলছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় কোনও জেলেকে শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। তবে জাল ও মাছ জব্দ করা হচ্ছে। জেলেদের জন্য তেমন কোনও সরকারি সহায়তা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি বলে স্বীকার করেছেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।

জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মো. ফেরদৌস খান বলেন, ‘জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানো হবে। আমরা আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবো।’

এদিকে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।

/এনআই/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ