নারায়ণগঞ্জে ফুটপাতে হকার বসানোকে কেন্দ্র করে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় মেয়র আইভী, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষের ঘটনায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শর্ট গানের দুই শতাধিক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর চাষাঢ়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এলাকাবাসী ও পুলিশ জানায়, নগরীর সৌন্দর্য্য অক্ষুণ্ন রাখতে সড়কের ফুটপাথগুলো হকারমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন মেয়র আইভী। তার এই সিদ্ধান্তে হকাররা প্রতিবাদ জানালে তাদের সমর্থন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য রাখার ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ মেয়র আইভী নগরীর ফুটপাথ থেকে হকারদের উচ্ছেদের ঘোষণা দিলে তাদের আবারও ফুটপাথে বসানোর ঘোষণা দেন শামীম ওসমান। এর প্রতিবাদে নগর ভবন থেকে পায়ে হেঁটে মেয়র আইভী তার নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিলসহ চাষাঢ়া এলাকায় আসেন। তারা মুক্তি জেনারেল হাসপাতালে সামনে এলে শামীম ওসমানের সমর্থক ও হকাররা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসময় শামীম ওসমানের সমর্থকরা যেদিকে অবস্থান করছিলেন সেদিক থেকে নিয়াজুল ইসলাম তাদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়ে। এসময় নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে মেয়র আইভীকে হামলা থেকে রক্ষা করেন। এরপর থেকেই উভয়পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। পুলিশের সঙ্গেও শামীম ওসমান সমর্থক ও হকারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দুই শতাধিক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। নগরীর চাষাঢ়া থেকে দুই নং রেল গেট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে হকারদের সমর্থনে এমপি শামীম ওসমান রাজপথে নেমে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধু সড়কে অবস্থান নেন। এসময় আহত আইভী নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে অবস্থান নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রেস ব্রিফিং করেন।
সেখানে আইভী বলেন, ‘শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ক্যাডাররা আমার ওপর এবং নিরীহ শহরবাসীর ওপর হামলা চালিয়েছে। এতে আমিসহ নারায়ণগঞ্জের যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছি। আমি নগর ভবন থেকে পায়ে হেঁটে চাষাঢ়া আসছিলাম প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন সম্পর্কে হকারদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের বলতে চেয়েছিলাম, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখার জন্য নির্দেশ আছে, আপনাদের বসানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হবে। এই কথা বলার জন্য আসছিলাম। কিন্তু শামীম ওসমানের নির্দেশে তার সমর্থকরা কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’
এদিকে, বঙ্গবন্ধু সড়কে দাঁড়িয়ে শামীম ওসমান বলেন, ‘কেউ কেউ চাচ্ছে গণ্ডগোল করে পরিস্থিতি অশান্ত করতে। এটা কোনও রাজনৈতিক সংগ্রাম না। হকাররা চেয়েছে ফুটপাতে বসতে। যারা নিরীহ হকারদের রক্ত ঝড়িয়েছে তাদের বিচার আল্লাহ করবে। নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করতে দেওয়া হবে না। আপনারা ধৈর্য ধরেন। কেউ যেন নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করতে না পারে।’
শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘আমি দেখেছি বিএনপির অনেক ক্যাডার মাঠে নেমেছে। বিএনপির মার্ডার কেসের আসামি আছে। মার্ডার কেসের আসামিরা মেয়রের পেছনে অস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। মেয়র বোকামি করতে পারে। আমি বোকা না। এ্টা কোনও রাজনৈতিক সংগ্রাম না। হকারার বসেবে কী বসবে না এটা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঠিক করবে। বিকল্প ব্যবস্থা না দেওয়া পর্যন্ত হকার আছে, হকার বসবে। আপনারা যদি সাহায্য করতে চান ওদের সঙ্গে আমি একাই পারি। দেখি কার কতো সাহস আছে। প্রশাসনের ভূমিকা যেটা ছিল পুলিশ নিয়েছে। আমাদের যদি মাঠে নামতে হয় এক হাজার দুই হাজার নামবে না। লাখ লাখ মানুষ মাঠে নামবে।’
প্রসঙ্গত নগরীর অক্ষুণ্ন রাখতে নারায়ণগঞ্জকে হকারমুক্ত করার ঘোষণা দেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ জন্য হকার্স মার্কেটও নির্মাণ করে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। কিন্তু হকাররা মেয়রের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালে তাদের সমর্থন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। গত ৯ জানুয়ারি নগরীর জিমখানা উন্মুক্ত মঞ্চে ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ও নগরবাসীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষে জনতার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানে মেয়র আইভী বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন। সেদিন তিনি শামীম ওসমানকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেন, ‘চার হাজার হকারের জন্য নগরীর পাঁচ লাখ মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। ফুটপাতে নগরবাসী চলাচল করবে। সিটি করপোরেশনের জরিপ অনুযায়ী হকার সংখ্যা মাত্র ৬শ’। কিন্তু,হকারদের দাবি চার হাজার। আর সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বক্তব্য অনুযায়ী হকারের সংখ্যা ১০ হাজার । তিনি এত হকার কোথায় পেলেন আমি তা জানি না। আমি হকারদের পেটে লাথি মারি নাই। বাংলাদেশে আমিই প্রথম হকারদের পুনর্বাসনের জন্য হকার্স মার্কেট নির্মাণ করে দিয়েছি। হকাররা সেই দোকান ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দামে বিক্রি করে আবার রাস্তায় নেমে এসেছে। শামীম ওসমান সাহেবের যদি হকারদের জন্য এতোই মায়া কান্না থাকে তবে তিনি হকারদের জন্য দুই একটি মার্কেট নির্মাণ করে দিলেই পারেন। যিনি ছেলের বিয়েতে ২৫ কোটি টাকা খরচ করতে পারেন তার জন্য গরিব হকারদের জন্য দুই চারটি মার্কেট নির্মাণ করে দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।’
এর দু’দিন পর ১১ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় মেয়র আইভীকে জবাব দিতে গিয়ে শামীম ওসমান বলেছিলেন,‘‘কেউ কেউ বলছে আমি নাকি ছেলের বিয়েতে ২৫ কোটি টাকা খরচা (খরচ) করেছি। আমি জানি না ২৫ কোটি টাকা কতগুলি টাকায় হয়। তারা বলে, গরিব হকারদের জন্য কিছু করছি না। তারা যেন দোয়া করে ২৫ কোটি নয়, ২৫০০ কোটি টাকা যেন খরচা করতে পারি গরিব জনগণের জন্য।’
এই তর্কযুদ্ধের পর হকার ইস্যুতে আজ উভয়পক্ষ মাঠে নেমে আসায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো।