X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

৭ ডিসেম্বর জামালপুরের ইসলামপুর মুক্ত দিবস

জামালপুর প্রতিনিধি
০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:১৩আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৩:৫৫

৭ ডিসেম্বর জামালপুরের ইসলামপুর মুক্ত দিবস ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর জামালপুরের ইসলামপুরের মাটি পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিল। হাজার মুক্তি কামী ছাত্র-জনতার আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে থানা চত্বরে জালাল কোম্পানির কমান্ডার প্রয়াত শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিনটি ইসলামপুরবাসীর জন্য অত্যান্ত গৌরবের।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন স্বাধীনসহ স্থানীয় মক্তিযোদ্ধারা জানান, যখন এই মাসের আগমন ঘটে তখনই মনটা ফিরে যায় অতীতের সেই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। বিশাল জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কণ্ঠে ঘোষিত হয় বাঙ্গালী জাতির বঞ্চনার ২৩ বছরের ইতিহাস । এবাবের সংগ্রাম আমাদের মক্তির সংগ্রাম,এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সে সময় উপজেলার উত্তর দরিয়াবাদ ফকিরপাড়ার সন্তান, জালাল কোম্পানির কমান্ডার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা’  মন্ত্রে উজ্জীবিত-উদ্দীপ্ত হয়ে সংগঠিত হন জামালপুর মহকুমাধীন ইসলামপুরসহ বিভিন্ন থানার সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা মুজাহিদ বাহিনীর শতাধিক সদস্য । ইসলামপুর জেজেকেএম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠে তারা সমবেত হন।
সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে এলাকার ছাত্র-যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ড্রিল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর টাঙ্গাইলের মধুপুরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার উদ্দেশে কমান্ডার আশরাফ ও শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০০ জন মুজাহিদ সদস্য জামালপুরের উদ্দেশে রওনা হন।

ওইদিন তারা জামালপুরে পিটিআই ও মহিলা কলেজে অবস্থান নেন। জামালপুর সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় জামালপুর ট্রেজারি থেকে ১০০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গুলি সংগ্রহ করা হয়। ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করে  ময়মনসিংহে অবস্থান নেন সেক্টর কমান্ডার, এস ফোর্সের অধিনায়ক ও বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ। তার নিদের্শনা ও নেতৃত্বে  ক্যাপ্টেন হাকিমের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর নামক স্থানে পাক হানারদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ ও সম্মুখ যুদ্ধ চলে।

পাক হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন সকলে। পাক হানাদার বাহিনী মধুপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত সব প্রতিরোধ ভেঙে ২২ এপ্রিল জামালপুর দখল করে নেয়। ২৭ এপ্রিল ইসলামপুর থানাও দখল হয়ে যায়। ইসলামপুর থানার রাজাকারদের সহায়তায় তারা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

পরবর্তীতে শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে টাঙ্গাইল প্রতিরোধ  যুদ্ধ থেকে ফেরত কিছু সংখ্যক মুজাহিদ সদস্য ও অন্যান্য পেশার লোকজনদের নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগদান করেন।

প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ, রাশেদ মোশারফ এমপিএ ও আশরাফ হোসেন এমপির নির্দেশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাক-হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে মতিউর রহমান মতি, গোলাম মোস্তুফা, মাওলানা আনোয়ার হোসেন, শাহাদত হোসেন মজির উদ্দিন আহমেদ, শ্রী পরিমল সেন (নারু বাবু), আঃ গণি সরদার, ইদ্রিস আলী বাহাদুর, ও স্কাউট লিডার শ্রী সুভাষ চন্দ্র দাসসহ উপস্থিত ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করেন।

ভারতের মহন্দেগঞ্জে প্রশিক্ষণ শিবিরে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অবস্থান করা হয়। বাছাইকৃত লোকদের তুরাসহ অন্যান্য স্থানে ভারতীর সামরিক বাহিনীর অধীনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠনো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তারা বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে শুরু করেন। ১২ আগস্ট কর্নেল আবু তাহের সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যোগদান করেন।

এ সময় ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন পেশার লোকজনদের নিয়ে জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক কোম্পানিটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইসলামপুর থানার সিরাজাবাদ এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে মাদারি ছন আখক্ষেত নামক স্থানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অপারেশন চালাতেন। জালালের নামে বাহিনিত পরিচিতি লাভ করে।  জালাল তার বাহিনী নিয়ে নিয়মিত পাক হানাদার ও রাজাকারদের স্থাপনায় হামলা চালান।

জালাল বাহিনী ইসলামপুরের পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখলের জন্য  ৬ ডিসেম্বর দুপুরে পলবান্ধা ইউনিয়নের পশ্চিম বাহাদুরপুর পাইমারী স্কুল মাঠ সংলগ্ন ইসলামপুর সিরাজাবাদ রোডে অবস্থান নেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেন। এক প্লাটুন থানা পরিষদের উত্তরপশ্চিম দিকে ঋষি পাড়া রেল ক্রসিং এলাকায়, ২ নম্বর প্লাটুন সর্দার পাড়া অস্টমিটেক খেয়া ঘাট সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ পাড়ে ইসলামপুর-সিরাজাবাদ রোড এলাকায়, ৩ নম্বর প্লাটুন থানার পূর্ব পাশে ইসলামপুর হাসপাতাল সংলগ্ন রোড়ে  এবং ৪ নম্বর রিজার্ভ প্লাটুন পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেয়।

ওইদিন দুপুর থেকে পরেরদিন ভোর  পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির দাপটে টিকতে না পেরে অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলে আকস্মিকভাবে রণে ভঙ্গ দিয়ে স্পেশাল ট্রেনে চেপে জামালপুরের দিকে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় ঝিনাই ব্রিজসহ তিনটি রেল ব্রিজ ধ্বংস করে জামালপুর পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন করে দেয়।

৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টার সময় থানা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মজির উদ্দিন আহমেদ, গণি সরদার, টুআইসি আলাউদ্দিন  জোরদার, প্লাটুন কমান্ডার শাহাদত হোসেন স্বাধীন ও হাজার হাজার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে থানা চত্বরে উপস্থিত হয়। সেখানে জালাল কোম্পানির কমান্ডার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন স্বাধীনতার বিজয়ের পর প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন।  সেই সাথে ইসলামপুরের মাটি হয় শত্রুমুক্ত। জালাল কোম্পানির কমান্ডার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন ২০১৭ সালের ২৭ আগষ্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

/এএমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!