ভাষা আন্দোলনের পর ৬৮ বছর পার হয়ে গেলো। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৮ বছর উদযাপন করলো জাতি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হলেও এত বছরও পরও কোনও ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি অনেক ভাষা সংগ্রামী। অনেকেই ভাগ্যেই জোটেনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনও সংবর্ধনা বা সম্মাননা। তেমনি চাঁদপুরের ২৭ ভাষা সংগ্রামীও রয়ে গেছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বাইরে। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই ২৭ জনই, তবে তাদের বা তাদের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি।
জেলার বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও ভাষা সংগ্রামীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে চাঁদপুরে ২৭ জন ভাষা সংগ্রামীর নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বাবা এম এ ওয়াদুদ পাটওয়ারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চাঁদপুর মহকুমা যুবলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এফ এম ফজলুল হক, ডা. মজিবুর রহমান চৌধুরী, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী টুনু, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সাবেক এমপি আবদুর রব, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল আউয়াল, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম, সাবেক গণপরিষদ সদস্য ও চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল করিম পাটওয়ারী, রফিক উদ্দিন আখন্দ ওরফে সোনা আখন্দ, বিএম কলিম উল্লাহ, মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট আবু জাফর মো. মাইনুদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবুল ফজল, হোমিও চিকিৎসক এ বি খান, আবদুল করিম খান, সুজাত আলী মুন্সী, তৎকালীন তরুণ সংগঠক শাহ্ আমান উল্লাহ মানিক, সাবেক এমপি নওজোয়ান ওয়ালি উল্লাহ, প্রবীন রাজনীতিবিদ আইনজীবী শেখ মতিউর রহমান, ডা. এম এ গফুর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমপি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফ্ফর আলী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, ডা. আবদুস ছাত্তার, বিশিষ্ট নারী সংগঠক সাবেক এমপি আমেনা বেগম।
গত দুই বছরে মারা গেছেন ভাষা সংগ্রামী চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান জেলা জাপার সভাপতি নূরুল হক বাচ্চু মিয়াজি ও ডা. এমএ গফুর। ভাষা সংগ্রামী ডা. আব্দুল গফুরের পরিবারের চাপা আক্ষেপ, প্রতি বছর একুশে পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে ‘রাজধানীভিত্তিক ভাবে’। অথচ গ্রামে বেঁচে থাকা ভাষা সংগ্রামীদের অথবা যারা মারা গেছেন, তাদের খুঁজে বের করে মরণোত্তর সম্মানটুকুও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে একদিন হয়তো তাদের নামগুলোই মুছে যেতে পারে।
১৯৫২ সালে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় মাতৃ ভাষা রক্ষায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। বাদ যায়নি চাঁদপুরও। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর শহরের আহম্মদিয়া মুসলিম হোস্টেলে (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ হোস্টেল) গোপনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা থেকেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ চাঁদপুর মহকুমা ইউনিট’। উপস্থিত সবার সম্মতিক্রমে ইউনিটের সভাপতি মনোনীত হন তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা আবদুর রব। তৎকালিন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রনেতা চাঁদপুর সদর উপজেলাধীন রাড়িরচর গ্রামের মোল্লা ছিদ্দিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এই ইউনিটের প্রতিনিধি হিসেবে চাঁদপুরের বিভিন্ন থানায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন ২৭ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন।
ভাষা সংগ্রামী শেখ মোজাফ্ফর আলীর ছেলে শেখ মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, ‘এত বছর পরেও চাঁদপুরের এই ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া কষ্টের। আমার বাবা মৃত্যুর আগে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থাও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় ছিলেন। কিন্তু তিনি তা পাননি। আমার বাবা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, কাজ করেছেন, তখন কিন্তু তারা এই স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে যাননি। মাতৃভাষার জন্য কাজ করেছেন সেটিই বড় কথা। তবে আমরা চাই, সরকার তাদের তালিকাভুক্ত করুক। আশা করি, কোনও একদিন হয়তো এই মহান মানুষগুলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পাবেন।’
ভাষা সংগ্রামী এ এফ এম ফজলুল হকের সন্তান মো. খায়রুল আহসান সুফিয়ান বলেন, ‘সব স্বীকৃতি রাজধানীভিত্তিক। যারা মফস্বলে বেঁচে আছেন, কিংবা মরে গেছেন তাদের কোনও খবর নেই। সারাদেশে কত জন ভাষা সংগ্রামী আছেন এর তালিকা করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা সংগ্রামীদেরও মূল্যায়ন করা উচিত।’
ভাষা সংগ্রামী আ. করিম পাটওয়ারীর সন্তান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল বলেন, ‘আমার বাবাসহ যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, তারা তো ভাষা আন্দোলন করেছেন বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেননি। এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি রাষ্ট্রের ব্যাপার।’