‘নদীর তীরের জমি হওয়ায় বর্ষায় পানি বেড়ে চলতি বছর বেশ কয়েকবার তলিয়েছে ধানের চারা। তাই প্রায় এক বিঘা ১২ কাঠা জমিতে (৭৭ শতক) ধানের তেমন ফলন হয়নি। তবে ওই জমিতে আগাম সবজি আবাদ করে বেশ ভালো দাম পাচ্ছি। এক বিঘা জমিতে (৪৮ শতক) সিম চাষ করেছি। বর্তমানে যে দামে বিক্রি হচ্ছে সেইভাবে দাম পাওয়া গেলে লাখ দেড়েক টাকা বিক্রি হবে। আর ১২ কাঠা জমিতে (২৯ শতক) ঢেঁড়স আবাদ করেছি। সেখানেও ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হবে। এই দুটি জমিতে খরচ ও শ্রম বাদ দিয়েও কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা আয় হবে।’
নিজ জমিতে দাঁড়িয়েই কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর সদর উপজেলার মহব্বতপুর এলাকার কৃষক ইসমাইল হোসেন। তিনি তার জমিতে মুলাটালী ও ঘিয়া জাতের সিম আবাদ করেছেন। সবেমাত্র তার ক্ষেতে সিমের উৎপাদন শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাজারে যা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা কেজি দরে। আর তার জমির ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি দরে। তবে তার জমির ঢেঁড়স প্রায় শেষের দিকে। গত তিন মাসে ১২ কাঠা জমিতে ঢেঁড়স বিক্রি করেছেন প্রায় ৪০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ‘এবারে দাম ভালো আছে। এভাবে দাম থাকলে ভালোই লাভ হবে। তবে এবারে বর্ষার কারণে আগাম জাতের আলু এখনও উঠতে শুরু করেনি। আরও এক মাস পর এই আলু উঠবে। আলুতেও ভালো দামের আশা করছি।’
দিনাজপুর সদরের উলিপুর, কসবা, মহব্বতপুর, পুলহাট, গৌরিপুরসহ দক্ষিণ কোতোয়ালি এলাকা সবজির জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিন এখান থেকে উৎপাদিত সবজি জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাই এই এলাকার মানুষ ধান কিংবা অন্য শস্য আবাদের চেয়ে শাক-সবজি আবাদকেই বেশি প্রাধান্য দেন।
কথা হয় মহব্বতপুর এলাকার আজাহার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এবারে যেমন দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে, তেমনিভাবে অনেকের আবাদ নষ্টও হয়েছে। আমার এক বিঘা জমিতে ধান আবাদ হয়নি। ওই জমিতে সিম চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ায় জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং সিমগাছগুলো মরে যায়। ফলে আমার প্রায় ১০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন ওই জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। তবে আলুতেও ভাল দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। যাতে করে ওই দুই ফসলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া যাবে।’
উলিপুর এলাকার কৃষক ইদ্রীস আলী বলেন, ‘এবারে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ায় এই এলাকায় আলুর আবাদ পিছিয়েছে। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে আগাম আলু উঠতো। তবে এবারে সঠিক সময়ে বীজ বপন করতে না পারায় আগাম আলু এখনও বাজারে উঠাতে পারিনি। আশা করছি আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে আমার ক্ষেতের আলু বাজারে উঠবে। আগাম আলুর দাম ভালো পাওয়া যায়। এই আলু কমপক্ষে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।’
কৃষক মোকসেদ আলী বলেন, ‘বর্তমানে আমার জমিতে উৎপাদিত বেগুন বিক্রি করছি ৪০ টাকা কেজি পাইকারি দরে। খুচরা বাজারে এই বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। একইভাবে ঢেঁড়স বিক্রি করছি ৩৫ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা ঢেঁড়স বিক্রি করছেন ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে। মুলাটালী জাতের সিম বিক্রি করছি ৬০ টাকা দরে যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ বাজারে প্রতিটি সবজিই ৫-১০ টাকা লাভে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।’
দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে বড় কাঁচা সবজির বাজার বসে জেলা শহরের বাহাদুর বাজার এনএ মার্কেটে। শুধু খুচরাই নয়, বরং পাইকারি হিসেবে কৃষকরা এখানে তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। সেগুলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
বুধবার (২৫ নভেম্বর) এই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সিম বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা কেজি দরে, বেগুন ৫০-৫৫ টাকা কেজি দরে, মুলা ৪০ টাকা কেজি, পটল ৫৫ টাকা, ফুলকপি ৯০ টাকা কেজি, বাধাকপি ৬০ টাকা কেজি, টমেটো ১৪০ টাকা কেজি, কাঁচামরিচ ১২০ টাকা কেজি, শসা ৫০ টাকা কেজি, ঢেরস ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর পুরাতন আলু প্রকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪৫ টাকা কেজি দরে। নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। তবে এই আলু দিনাজপুর জেলার নয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ওই বাজারের দোকানি নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এবারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় সব শাক-সবজির দাম একটু বেশি। এই দাম কমার সম্ভাবনা থাকলেও খুবই কম। কারণ জেলার যেমন চাহিদা রয়েছে তেমনিভাবে চাহিদা রয়েছে বাইরের। বর্তমানে আলুর দামও বেশি। এখনও দিনাজপুরের আলু উঠতে শুরু করেনি। যে আলু পাওয়া যাচ্ছে তা ঠাকুরগাঁও কিংবা পঞ্চগড়ের আলু। তবে আগাম আলু উঠলেও এই দাম কমার কোনও সম্ভাবনা নাই, বরং দিনাজপুরের আগাম জাতের আলুর দাম আরও বেশি হতে পারে।’
ওই বাজারে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিন বলেন, ‘আসলে কৃষক পর্যায়ের থেকে একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দোকানভাড়া, গাড়িভাড়া, শ্রমের মূল্য যোগ হচ্ছে। এবারে সবজির যে দাম তাতে করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন এটা যেমন ঠিক, তেমনিভাবে ব্যবসায়ীরাও লাভবান হচ্ছেন। চাহিদার তুলনায় যোগান কম থাকায় দ্রব্যমূল্য একটু বেশি। তাছাড়া এখন সব জিনিসেরই দাম বেশি, ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শাক-সবজির দামও।’
এদিকে দাম বেশি হওয়ায় খুশি নন ক্রেতারা। সবজি কিনতে আসা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক হালি লেবুর দাম ১৫-২০ টাকা, এক কেজি বেগুন ৫৫ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকা। এত দাম দিয়ে সবজি কেনা যায় বলেন? এখন তো শাক-সবজির চেয়ে ডিম কিংবা মাছ খাওয়া ভালো। প্রায় প্রতিটি তরকারিতে প্রয়োজন হয় আলুর। সেই আলু এখন ৪০ টাকার ওপরে। কী কিনে খাবো বলেন?’ আরেক ক্রেতা শ্যামল কুমার রায় বলেন, ‘যারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারে না তাদের জন্য শাক-সবজি ছিল। এখন দেখছি শাক-সবজির যে দাম তাতে করে লবণ দিয়েই ভাত খেতে হবে। শাক-সবজিতে পুষ্টির যে পরিমাণগুলো থাকে তা পূরণ করা এখন আমাদের মত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সমস্যা। সরকারকে এদিকে নজর রাখার দাবি জানাই।’
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল জানান, চলতি বছরে জেলায় ১৪ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সাত হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজি উৎপাদন করা হয়েছে। এর মধ্যে বাঁধাকপি ৮৬৭ হেক্টর, ফুলকপি ৯২৫ হেক্টর, বেগুন ১৫৭৫ হেক্টর, ঢেঁড়স ৩৬ হেক্টর, শিম ৪০৭ হেক্টর, বরবটি ৭০ হেক্টর, টমেটো ৩২৬ হেক্টর, গাজর ৭৪ হেক্টর, করল্লা ১৬৭ হেক্টর, শসা ১৪৬ হেক্টর, খিরা ২৫ হেক্টর, মূলা ৫২৫ হেক্টর, চাল কুমড়া ৪৬ হেক্টর, পেঁপে ৭৮ হেক্টর, মিষ্টিকুমড়া ১৮০ হেক্টর, ধনে পাতা ৪৫ হেক্টর, লাল শাক ১৮৪ হেক্টর, পুঁই শাক ৬৯ হেক্টর, পালং শাক ১০৪ হেক্টর, ডাটা শাক ৭৫ হেক্টর, কলমি শাক ৫৯ হেক্টর, লাউ ৪১৫ হেক্টর এবং অন্যান্য শাক-সবজি ৭০২ হেক্টর।