আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগানগুলো থেকে আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। বুধবার গোপালভোগসহ গুটি আম সংগ্রহের মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালের মতো এবারও দেশের জনপ্রিয়তম ফলটি সংগ্রহের এই আনুষ্ঠানিকতা আরম্ভ হলো।
এ উপলক্ষে বুধবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ‘আম উৎসব’ পালিত হয়। এসময় বাগানের গাছ থেকে কয়েকটি আম পেড়ে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. জাহিদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার আমচাষিদের সুবিধার্থে আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রশাসন। এর ফলে আম বিক্রি নিয়ে চাষিদের আর ভাবতে হবে না। আম বাজারজাতকরণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আমচাষি ও গবেষক-বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে। তাই এতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি জানান, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আম যাতে বাজারে ওঠে সেজন্য প্রশাসনের মনিটরিং অব্যাহত থাকবে।
এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক মো. সাজদার হোসেন, চাঁপাই নবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রর পরিচালক মো. হামীম রেজা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, জেলার সুস্বাদু আমের ঐতিহ্য এবং সম্মান ধরে রাখার জন্য অপরিপক্ব আম পেড়ে কেউ যেন কেমিক্যাল দিয়ে তা পাকাতে না পারে, সেজন্য সবার মতামতের ভিত্তিতে ২৫ মে গোপালভোগসহ গুটি জাতীয় আম; ১ জুন হিমসাগর/খিরসাপাত ও লক্ষণভোগ; ১০ জুন ল্যাংড়া ও বোম্বাই; ২৫ জুন আম্রপালি; ফজলি ১ জুলাই; ১৫ জুলাই আশ্বিনা আম বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এ সময়ের আগে কেউ আম পেড়ে বাজারজাত করলে মনিটরিং কমিটি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এ মৌসুমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, পিজিআর, ফরমালিন, ইভাফনের মাধ্যমে আম পাকানো বন্ধে হাট-বাজারসহ জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে উদ্বুদ্ধকরণসভা, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান সক্রিয় থাকবে।
এদিকে ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে আম পেকে যাওয়া ও বাজারজাত করতে না পারায় আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ নিয়ে অঞ্চলটির আমচাষি ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্ট হয় টানাপড়েন। এ বছর যেন আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, এ বিষয়ে সচেতন থেকে প্রশাসন ২৫ মে’র আগে বাগানের আম পাড়া বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করে।
এ নিয়ে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছরের চেয়ে সময় এগিয়ে নেওয়ায় আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তাদের তাছে বিষমুক্ত আম পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেবেন বলে মনে করি।
জেলা প্রশাসক ইতিবাচক প্রত্যাশা জ্ঞাপন করলেও বেঁধে দেওয়া এই সময় নিয়ে চাষিদের মধ্যে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, এতে করে হয়রানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে আম সংশ্লিষ্টরা। শিবগঞ্জের ছত্রাজিতপুরের আমচাষি একরামুল হক ও কানসাটের আমবাগান মালিক নূরুল ইসলামের ভাষ্য, প্রাকৃতিক ফল আম; আর প্রাকৃতিক নিয়মেই এই ফল পাকে। নদীর স্রোতকে যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি আম কখন পাকবে তার সময় নির্ধারণ করা যায় না। আবহাওয়াগত কারণে কোনও বছর আম দশদিন আগেই পাকে আবার কোনও বছর দশদিন পরে। তাই গতবারের মত এবারও তারা আম বাজারজাতকরণে প্রশাসন কর্তৃক হয়রানি এবং ক্ষতির সম্মুখীন হতে হওয়ার আশঙ্কা করছি।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর মৌসুমের শুরুতে বাম্পার মুকুল আসলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না ঘটাসহ তাপদাহের কারণে জেলার বেশিরভাগ বাগানেই আম ধরেছে বিগত সময়ের তুলনায় কম। এই সুযোগে কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে ভারতীয় আম যদি দেশের বাজার দখল করে, তাহলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে তারা পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন। তাদের দাবি, ফলন কম হওয়ার সুযোগ অনেক ব্যবসায়ী নিতে চাইলেও সরকার ভারতীয় আম আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে যেন চাষিদের পাশে থাকেন।
ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চুটু জানান, ‘ইতোমধ্যে চাষি ও ব্যবসায়ীরা আম বাজারজাতকরণের প্রস্তুতি হিসেবে আড়তের ঘর মেরামত, ডালিসহ উপকরণ মজুদ করা শুরু করেছে। তবে এবারে আমের ফলন কম হওয়ার সুযোগে ভারতীয় আমের আমদানি করা হতে পারে। গত ২ বছরে আম ব্যবসায়ীদের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে এবার ভারত থেকে আম আমদানি বন্ধ রাখার দাবি জানাই।
আরও পড়তে পারেন:
চার শিশু হত্যা মামলার বাদীকে ‘হত্যার হুমকি’!
জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট আম আড়তদার সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান জানান, জেলায় এ বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার আম ব্যবসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফল ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের আমের ব্যাপারীরা পূর্বের বকেয়া পরিশোধ করে জেলার কানসাট, শিবগঞ্জ, ভোলাহাটের আম ফাউন্ডেশন, রহনপুর, মল্লিকপুর, সদরঘাট আমবাজারের আড়তগুলোয় আসতে শুরু করেছেন। ২৫ মে থেকে আগামজাতের গোপালভোগসহ গুটি আম দেশের বিভন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য অগ্রিম অনুরোধ করাও শুরু হয়ে গেছে।
জানা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক, কুরিয়ার সার্ভিস, আবাসিক ও খাবার হোটেল মালিকরা আকর্ষণীয় সব সেবা আম ব্যবসায়ীদের দেওয়ার জন্য বড় বড় আমবাজার এবং আড়তে আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। এসময় জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হওয়ার পাশাপাশি প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে ব্যবসা-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সাজদার রহমান জানান, চলতি বছর জেলার পাঁচ উপজেলায় ২৪ হাজার ৪শ’ ৭০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। আর কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে জেলায় এবার ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হওয়া সম্ভব। এ বছর জেলার প্রায় প্রতিটি আমবাগানে প্রচুর মুকুল এলেও মেঘলা আবহাওয়া ও যথেষ্ট পরাগায়ন না ঘটার কারণে আমের গুটি কম এসেছে। তার ওপর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শিলাবৃষ্টি ও অব্যাহত তাপদাহে আমের ফলনে নেমে আসে বড় বিপর্যয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন জানান, বিরূপ আবহাওয়া ও কম পরাগায়নে আমের গুটি কম এলেও এখনও যে পরিমাণ আম উৎপাদিত হয়েছে তাতে এবার চাষিরা ভালো দাম পেয়ে লাভবান হবেন।
তিনি বলেন, আমচাষিরা গত বছর ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিতে আমের দাম ভালো পাওয়ায় এবারও অনেকে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ফলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতির বেশিরভাগ আম ইউরোপসহ ইংল্যান্ডে রফতানি হয়েছিল। এবারও এই ব্যাগিং পদ্ধতির আম বিদেশে রফতানি হবে।
বাংলাদেশের সব জেলাতে কমবেশি আম উৎপাদিত হলেও পরিমাণ ও মানের দিক থেকে প্রকৃতি ও জলবায়ুগত কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আম অনেক এগিয়ে। তাই অনিবার্যভাবে এ ফলকে ঘিরেই আর্বতিত হয় অঞ্চলটির মানুষের জীবন ও জীবিকা। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে এবার লাভের মুখ দেখবেন এখানকার আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা, এমনটাই আশা করছেন প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
/এইচকে/টিএন/
আরও পড়তে পারেন: