রাজশাহীতে এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে আলুর নেই বললেই। এখন আলু বিক্রি করে কৃষকের খরচ উঠছে না। ফলে কৃষক রেখে দিচ্ছেন হিমাগারে। কিন্তু সেখানেও ভর করেছে সিন্ডিকেট। অনেক কৃষক আগেভাগে বুকিং দেওয়ার পরও হিমাগারে আলু রাখতে পারছেন না। দলীয় প্রভাবে সিন্ডিকেট করে আলু হিমাগারে ঢোকাচ্ছে একটি চক্র। ফলে অসহায় অনেক কৃষকের আলু জমিতেই পড়ে আছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে আরও সাড়ে তিন হাজার হেক্টর বেশি জমিতে চাষ হয়েছে। উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে ১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল নয় লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসাবে এবার ৯০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন বেশি হয়েছে বলে আশা করা যায়।
তানোরের কৃষ্ণপুর গ্রামের আলুচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আলু তোলা শুরু হয়। প্রথম দিকে জমিতে ১২-১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। এখন তা ৯ টাকায় নেমেছে। অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। আমার প্রতি বিঘায় গড়ে ফলন হয়েছে ৫৫ বস্তা। সে হিসাবে এক বিঘায় ফলন প্রায় ৬৯ মণ। এখন জমিতে বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা কেজি দরে। এক বিঘা জমির আলু বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ২৪ হাজার ৮৪০ টাকা। অথচ কৃষ্ণপুর এলাকায় আমার প্রতি বিঘা জমি ইজারা নেওয়া আছে ২৭ হাজার টাকায়।’
তানোরে আলু চাষের জন্য জমির বিঘা ২০-৩০ হাজার টাকায় ইজারা নিতে হয় উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ ছাড়া প্রতি বিঘায় চাষে খরচ হয় আরও ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এখন বিক্রি করলে এই টাকার পুরোটিই লোকসানের খাতায় যোগ হবে। এ অবস্থায় আমরা হিমাগারে সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। কিন্তু সেখানে জায়গা হচ্ছে না। অনেক কৃষক আগাম বুকিং দেওয়ার পরও হিমাগারে আলু রাখা যাচ্ছে না। একটি সিন্ডিকেট দলীয় প্রভাব দেখিয়ে নিজেদের পরিচিতজনদের আলু হিমাগারে রাখছেন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় তিন লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টন। কিন্তু সংরক্ষণের জন্য ২২১টি হিমাগারের ধারণক্ষমতা মাত্র ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টন, যা উৎপাদিত আলুর মাত্র ২৩ শতাংশ। ফলে বাকি ৭৫ লাখ ২৩ হাজার টন আলু কৃষকরা বাড়িতে সংরক্ষণ বা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ আলু বিক্রি করার কারণে কমে গেছে দাম। অনেক জায়গায় ক্রেতাও মিলছে না।
ন্যায্য দাম পাচ্ছি না, ক্রেতাও মিলছে না জানিয়ে তানোরের চিমনা গ্রামের আলু চাষি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমার ৪০ একর জমিতে প্রায় সাত হাজার বস্তা আলু উৎপাদন হয়েছে। তানোরের আড়াদীঘি এলাকায় অবস্থিত রহমান কোল্ড স্টোরেজের ইউনিট-২ এ রাখার জন্য আগাম বুকিং দিয়েছিলাম। এখন অর্ধেক আলু নেওয়ার পর হিমাগারটি আর নিচ্ছে না। পাঁচ দিন আগে আলু তোলার পর এখন জমিতেই বস্তা করে ফেলে রেখেছি। জমি থেকে বিক্রি করলে কেজিতে নয় টাকা পাচ্ছি।’
স্থানীয় এক কৃষকের অভিযোগ, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে একটি সিন্ডিকেট বুকিং ছাড়াই জোর করে আলু হিমাগারে রাখছে। আলু রাখার সুযোগ করে দেওয়ার বিপরীতে সিন্ডিকেটটি কৃষকের কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নিজে আলু রাখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় এই কৃষক নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
রহমান কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক সৈয়দ আবদুল মুনিম কাজল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট বলে আসলে কিছু নেই। তবে দলীয় প্রভাবে কেউ এলে আগাম বুকিং ছাড়া হয়তো ২০ বস্তা বা ৫০ বস্তা নেওয়া যায়। এর বাইরে তো বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই।’
আগাম বুকিং নিয়েও অনেক কৃষকের আলু না রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রচুর ফলন হয়েছে। যারা আগাম টাকা দিয়ে বুকিং দিয়েছেন, তাদের ফেরানোর সুযোগ নেই। তবে মৌখিক বুকিংয়ের সব আলু নেওয়া যাচ্ছে না। কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা কম। ক্যাপাসিটিও কম। আমার এখানে সাড়ে তিন লাখ বস্তা নিতে পারবো, ইতিমধ্যে তিন লাখ ১০ হাজার বস্তা ঢুকেছে। কিন্তু মাঠে এখনও প্রচুর আলু আছে। তারপরও এলাকায় কিছু কোল্ড স্টোরেজ থাকায় দাম ৯ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। তা না হলে কেজি এক টাকায় বিক্রি করা লাগতো।’
মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ এলাকার চাষি জাহিদুল করিম বলেন, ‘আমরারা সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত। এবার ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম পাচ্ছি না। কোল্ড স্টোরেজে জায়গা পাচ্ছি না। আবার গত বছর কেজিপ্রতি কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া ছিল চার টাকা। এবার তা বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে। তারপরও দাম না পেলে কৃষকের লাভ হবে না। এবারের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। ফলে দাম কম।’
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় হিমাগার রহমান কোল্ড স্টোরেজের সামনে ২১ মার্চ এক কিলোমিটার দীর্ঘ আলুর গাড়ির সারি বৃষ্টিতে ভিজেছে সারাদিন। এই হিমাগারে ব্যবস্থাপক আব্দুল হালিম বললেন, ‘এখন বাজারে দাম কম। তাই চাষিরা আলু নিয়ে কোল্ড স্টোরেজমুখী হয়েছেন। এই কোল্ড স্টোরেজটি রাজশাহীর মধ্যে সবচেয়ে বড়। ধারণক্ষমতা ৩০ হাজার মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে এর ৭৫ ভাগ ধারণক্ষমতা পূরণ হয়ে গেছে।’
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গড়ে রাজশাহীর হিমাগারগুলোর ধারণক্ষমতার ৯০ ভাগ পূরণ হয়ে গেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব হিমাগার বন্ধ হয়ে যাবে। বাকি আলু বাইরে থেকে যাবে। প্রতি বছর কিছু আলো বাইরে থেকে যায়। এবার উৎপাদন বেশি হয়েছে। তাই বেশি পরিমাণ বাইরে থাকবে। বাইরে রাখা এসব আলু দিয়েই আগামী দুই মাস বাজার চালু থাকে। এবারও তাই থাকবে। তারপরে হিমাগারের আলু বের হবে। তখন কিছুটা দাম বাড়বে আশা করা যায়।’
বৃষ্টিতে ভেজা আলু নষ্ট হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বৃষ্টিতে তেমন ক্ষতি হবে না। হিমাগারের ভেতরে এলে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে যাবে। আর বেশি ভিজলে বস্তা পাল্টে রাখতে হবে।’