X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
করতোয়ায় নৌকাডুবিতে ৬৯ মৃত্যু

পূজার উৎসব কেটে গেলো বিষাদে, থামেনি স্বজনহারাদের কান্না

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়
০৫ অক্টোবর ২০২২, ২২:৫০আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ২৩:০০

এবার দুর্গোৎসবের আনন্দ ছিল না পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় স্বজনহারা পরিবারগুলোতে। সারা দেশে যখন সনাতন ধর্মালম্বীদের পরিবারে উৎসব চলছিল তখন স্বজন হারানোর বেদনায় কাঁদছিল ওসব পরিবারের বাবা-মা, ভাইবোন এবং স্ত্রী-সন্তান। প্রিয়জনদের হারিয়ে বিষাদে কেটে গেছে তাদের দুর্গোৎসব।

নৌকাডুবির ঘটনায় মৃতদের স্মরণে এবার দুর্গোৎসব অনাড়ম্বরভাবে পালন করেছে জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদ জেলা শাখা। প্রতিটি মণ্ডপে শোকব্যানার, কালোব্যাজ ধারণ এবং মৃতদের আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করা হয়েছে। 

বুধবার (০৫ অক্টোবর) প্রতিমা বিসর্জনের আগে মণ্ডপে মণ্ডপে মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন পুরোহিত ও ভক্তরা। মুছে গেছে বরদেশ্বরী মন্দিরে উৎসবের রং। দুর্গাপূজার মহালয়ায় যোগ দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারানোদের স্মরণে এখনও শোক পালন করছেন পুণ্যার্থীরা। মন্দির এলাকায় ভক্ত ও অনুসারীদের সমাগম তেমন ছিল না।

সরেজমিনে মাড়েয়া বামনহাটের কয়েকটি মণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, দেবী ও মণ্ডপগুলো সাজানো হলেও ভক্ত-স্বজনদের মাঝে উচ্ছ্বাস ছিল না। মণ্ডপে বাজেনি ঢাকঢোল, তবলা, বাঁশি ও মাইক। দূর থেকে শোনা যায়নি সন্ধ্যা আরতির বাজনা। বিষাদে পরিণত হলো উৎসবের আনন্দ। মণ্ডপগুলোতে ভক্তদের উপস্থিতি ছিল কম।

পুরোহিত ও ভক্তরা বলেছেন, এবার দেবী দুর্গা ধরায় এসেছেন গজে চড়ে। আমরা উৎসবের সঙ্গে তাকে নৌকায় করে বিদায় দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে নারী-শিশুসহ ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এজন্য প্রতিটি মণ্ডপের গেটে ঝুলছে শোকের ব্যানার। আরতিতে হয়নি নৃত্য। নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করেনি কেউ। জেলার ২৯৬টি মণ্ডপে নেমেছে শোকের ছায়া। এই শোক ভুলবার নয়।

জগদীশ চন্দ্রের মা নুনী বালা এখনও কাঁদছেন

ওই দিন নৌকাডুবিতে মারা যান মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী গ্রামের হরি কিশোর ও কনিকা রানী। বাবা-মাকে হারিয়ে অসহায় তাদের সন্তান উজ্জ্বল কুমার রায় ও অজয় কুমার। গত কয়েকদিন বাসা থেকে বের হননি। গত বছর দুর্গোৎসবে মা-বাবাকে নিয়ে আনন্দ করেছেন, ঘুরেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে। সেসব স্মৃতি মনে করে এক ভাই অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। দুই ভাইয়ের কান্না দেখে কেঁদেছেন গ্রামের সবাই। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারও।

একই ঘটনায় মারা গেছেন বটতলী গ্রামের জগদীশ চন্দ্র। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম জগদীশের মৃত্যুতে করতোয়ার জলে ভেসে গেছে পরিবারের চার সদস্যের দুর্গোৎসব। 

ময়দানদিঘী ইউনিয়নের খালপাড়া এলাকার বাসিন্দা হিমালয়কে হারিয়ে স্ত্রী বন্যা রানী এখনও বাকরুদ্ধ। গত কয়েকদিন শয্যাশায়ী। হিমালয়ের মৃত্যুতে মা-বাবা কাঁদছেন নীরবে। তাদের মাঝে ছিল না দুর্গোৎসবের আমেজ।

পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়ে স্তব্ধ দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা এলাকার জলেশ্বরী রানী (৬০)। স্বামী বীরেন চন্দ্র রায়কে হারিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তিন ছেলে এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখেই ছিলেন। নৌকাডুবিতে দুই পুত্রবধূ ও দুই নাতি হারিয়েছেন। এখনও কান্না থামেনি। উৎসবের আনন্দ তার কাছে ফিকে।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজি শিকারপুর এলাকার দুই ভাই হেমন্ত রায় ও বাসুদেব রায়ের পরিবারেও নেই উৎসবের আমেজ। স্ত্রী-সন্তানদের হারিয়ে শোকে পাথর দুজনেই। যাননি কোনও মন্দিরে।

হরি কিশোরের বড় ছেলে উজ্জ্বল কুমার বলেন, ‘আমার বাবা নেই, মাও নেই। কীভাবে পূজায় যাবো? এবার পূজা মণ্ডপের গেটটিও দেখিনি। বাবা-মাকে ছাড়া দুই ভাই অসহায়। এজন্য বাড়ি থেকে বের হইনি।’

স্বামীকে হারিয়ে এখনও কাঁদছেন বটতলীর ফুলমতি। তিনি বলেন, ‘গত বছর স্বামীর সঙ্গে মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিলাম। এবার যাইনি। যাবো কীভাবে? যার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল সে-ই তো নেই।’

বাবা-মাকে হারিয়েছেন উজ্জ্বল কুমার রায় ও অজয় কুমার

জগদীশ চন্দ্রের মা নুনী বালা বলেন, ‘হামার ছেলে হারিয়েছি। হামার দিন যাচ্ছে কান্দিতে কান্দিতে। পূজা করিবার রং হামার নাই।’

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ দেবীগঞ্জ উপজেলার সভাপতি হরিশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা আপনজনদের হারিয়েছি। কারও মনে উৎসব নেই। মণ্ডপগুলোতে ভিড়ও নেই। সবাই শোক পালন করছি। এই শোককে শক্তিতে সঞ্চয় করবো আমরা। মা দুর্গার কৃপায় ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে—সেটাই কামনা করছি।’

পূজা উদযাপন পরিষদ জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবধন বর্মণ ও সাধারণ সম্পাদক বিপেন চন্দ্র রায় জানান, নৌকাডুবির ঘটনায় এবার দুর্গোৎসব বিষাদে পরিণত হয়েছে। গোটা জেলায় মৃতদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করা হয়েছে। দেবীর ভালোবাসায় স্বজনহারা পরিবারগুলোর শোক শক্তিতে রূপান্তরিত হবে—এমনটি আশা করছি আমরা।’

এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বোদা উপজেলার ৪৬, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৭, আটোয়ারীর দুই, পঞ্চগড় সদরের এক এবং ঠাকুরগাঁও সদরের তিন জন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৮, নারী ৩০ এবং শিশু ২১ জন। তিন জন নিখোঁজ রয়েছেন।

তারা হলেন—দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর হাতিডুবা গ্রামের মদন চন্দ্রের ছেলে ভুপেন ওরফে পানিয়া, বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন এবং পঞ্চগড় সদরের ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথের মেয়ে জয়া রানী।

/এএম/
সম্পর্কিত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ৫ জন মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষোভ
ডেমরায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়