দিনাজপুর শহরের গুঞ্জাবাড়ী এলাকা থেকে মাতাসাগর হয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে রাজারামপুর এলাকায়। রাস্তার দুই পাশে তাকালে দেখা যায়, আবাদি জমি দখল করে গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। অথচ তিন-চার বছর আগেও এ অবস্থা ছিল না। এই রাস্তার দুই পাশ ছিল সবুজের সমারোহ। ফসলে ফসলে ভরা ছিল মাঠ। সে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে এখন গড়ে উঠছে বসতবাড়ি ও দালানকোঠা।
শুধু এই রাস্তার দুই পাশ নয়; রাজারামপুর থেকে নহনা, শহরের মহারাজা এলাকা থেকে পার্বতীপুর, দিনাজপুর-ফুলবাড়ী, দিনাজপুর-বীরগঞ্জ, দিনাজপুর-বিরলসহ সব সড়ক ও মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, আবাসন, শপিংমল ও কলকারখানা। এর বাইরে কৃষিজমির ওপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ইটভাটা। গোটা জেলার এমন চিত্র কৃষিজমি গ্রাস করেছে। ফলে হুমকিতে পড়েছে কৃষি অর্থনীতি।
পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলছেন, শস্যভান্ডারখ্যাত দিনাজপুর জেলার কৃষিজমি দিন দিন কমছে। কমেছে উৎপাদনের পরিমাণ। কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত আবাসন, কলকারখানা আর ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি এসব কলকারখানা আর ইটভাটার কালো ধোঁয়া নষ্ট করছে ফসল।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে ধান ও লিচুর মুকুলের পরিমাণ কমেছে। এর কারণ হিসেবে কলকারখানা আর ইটভাটার কালো ধোঁয়াকে দুষছেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর। এই জমিতে উৎপাদিত ধানের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের খাদ্য চাহিদায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। এখন পর্যন্ত কী পরিমাণে আবাদি জমি কমেছে, তার নির্দিষ্ট হিসাব নেই কৃষি দফতরের কাছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলায় উল্লেখযোগ্য ফসল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে গত শীতকালীন মৌসুমে শাকসবজি আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৬৭৩ হেক্টর জমিতে। একইভাবে টমেটোর আবাদ হয়েছে ৯৫৫ হেক্টর, আমন ধান ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৩৫ হেক্টর, বোরো ধান ১ লাখ ৭১ হাজার, সরিষা ১৬ হাজার ১০০ হেক্টর, গম ৩ হাজার ৫৫০ হেক্টর, ভুট্টা ৭০ হাজার ৪৫০ হেক্টর, আলু ৮৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর এবং প্রায় ৬ হাজার ৫৪৬ হেক্টর জমিতে লিচু হয়েছে।
দিনাজপুর সদরের যোগেনবাবুর মাঠ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল সালাম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ছিল যোগেনবাবুর মাঠে। ওখানে অনেক বসতি গড়ে উঠেছে। পরিবেশটাও অন্য রকম হয়ে গেছে। তাই গুঞ্জাবাড়ি এলাকায় ফাঁকা একটা জায়গা পেয়েছি। সেখানে বাড়ি করেছি। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের বাড়ির চাহিদা বাড়ছে। কিছু করার নেই। কারণ কোনও বাবার যদি চার ছেলে থাকে, চার জনেরই ঘর লাগে। ফলে জমির পরিমাণ তো দিন দিনই কমবে।’
গুঞ্জাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা শিবেন বলেন, ‘একসময় এলাকাটি ছিল কৃষিজমির। এখন চারদিকে বাড়ি আর বাড়ি। রাস্তার পাশের জমিগুলোতে দোকান হচ্ছে। মেডিকেল থেকে যে রাস্তা ফুলবাড়ীর দিকে গেছে, তার দুই পাশে আগে কিছুই ছিল না। এখন বহু আবাসন। এতে আবাদি জমি কমেছে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি হচ্ছে। ধান ও ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।’
একই এলাকার কৃষক রঞ্জিত সাহা বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে আবাদ করি। আগের মতো ধান উৎপাদন হয় না। আগে যে সুগন্ধি ধান ছিল, সেগুলো এখন নেই। কাঠারি ধান আছে। কিন্তু আগের মতো গন্ধ নেই। উৎপাদনের পরিমাণ কমেছে। কৃষকরা আগের মতো ফলন পান না।’
সদরের শেখপুরা এলাকার দুখুরাম রায় নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমি এক জমিতে গত পাঁচ বছর ধরে টমেটো আবাদ করছি। কিন্তু টমেটোর উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে প্রতি বিঘায় ৫০০ মণ করে উৎপাদন হতো। এখন উৎপাদন হয় ১০০ থেকে ১৫০ মণ।’
একই কথা বলেছেন গোপালগঞ্জ এলাকার কৃষক তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখন টমেটোতে অনেক রকম রোগ-বালাই হয়। ভালো ফলন হচ্ছে না। আবার গাছে গাছে ইটভাটার ছাই, এর কারণে ফলন কমছে।’
উলিপুর এলাকার কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আগে প্রচুর লিচু হতো। এখন তেমন হচ্ছে না। গাছে গাছে চালকল আর ইটভাটার ছাইয়ের কারণে হয়তো মুকুল আসছে না। তাছাড়া কালো ধোঁয়া তো আছেই।’
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘আগের চেয়ে আবাদি জমি কমেছে। বসতবাড়ি, দোকানপাট ও কলকারখানা হচ্ছে প্রতিদিন। আবাদি জমিতে কোনোভাবেই এসব করা যাবে না নির্দিষ্ট করে বলা থাকলেও কেউ তা মানছে না। ফলে দিন দিন জেলার কৃষি অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ছে। একদিকে আবাদি জমিতে কলকারখানা হওয়ায় জমির পরিমাণ কমছে, আবার দূষিত বায়ু ও ছাইযুক্ত বায়ুর কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।’
দিনাজপুর কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কোনোভাবেই যাতে উদ্ভিদের ওপর কালো ধোঁয়া কিংবা ছাইয়ের প্রভাব না আসে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এগুলো অবশ্যই উদ্ভিদের ক্ষতি করে। মুকুল ও ফল কম হওয়ায় অবশ্যই এর প্রভাব আছে।’
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, ‘যদি আবাদি জমি কমে যায়, সেগুলোর ওপর বাড়িঘর কিংবা কলকারখানা এবং ইটভাটা হয়; তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। কলকারখানা গড়ে উঠুক, কিন্তু অবশ্যই তা ফসলি কিংবা কৃষিজমির ওপর নয়। সেগুলোর জন্য বিসিক কিংবা অর্থনৈতিক অঞ্চল করে পরিকল্পিতভাবে করা উচিত। যাতে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হয়। কৃষিনির্ভর এই জেলায় যদি আবাদি জমি কমে যায়, ফসলের ক্ষতি হয়; তাহলে তো অর্থনীতিতে আঘাত পড়বে এবং তার অভাব আমাদেরও ভোগ করতে হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতি বছর আবাদি জমি কমছে এটি সত্য। তবে আমরা আবাদি জমির ওপর আবাসন কিংবা কলকারখানা করতে নিরুৎসাহিত করছি।’
গত ১০ বছরে কী পরিমাণ কৃষিজমি কমেছে জানতে চাইলে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘তার নির্দিষ্ট হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে এটা আমাদের রিপোর্টে আছে।’
জেলার কৃষক ও কৃষি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দিনাজপুর অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শাহ আলম। তিনি বলেন, ‘দিনাজপুর শস্যভান্ডারখ্যাত জেলা। এই অঞ্চলে মোট উৎপাদনের প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন চাল দেশের অন্যান্য জেলায় যায়। সম্প্রতি দেখেছি, যত্রতত্র আবাসন প্রকল্পের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে কৃষি জমিগুলো দখল করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা গড়ে কৃষিজমি দখল করা হয়েছে। ফলে কৃষিজমি কমেছে।’
কৃষিবিদ শাহ আলম আরও বলেন, ‘ইটভাটা নির্মাণের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট আইন আছে। ২০১৩ সালের ৬৯ নম্বর আইনে বলা আছে, ‘এক জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন হয়, এমন জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।’ আবাসনের ক্ষেত্রেও একই কথা আইনে বলা আছে। যদি আবাসন করতেই হয়, তবে সমান্তরালভাবে না করে উল্লম্বভাবে করতে হবে। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একই জমিতে বারবার একই ফসল না ফলিয়ে একটু পরিবর্তন করে ফসল আবাদ করা দরকার। তাছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা আছেন। তাদের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে।’