X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকা ডুবে ৭২ জনের মৃত্যু, এক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:৫৯আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:৫৯

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নৌকাডুবির ঘটনায় ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কান্না থামেনি। দুর্ঘটনার পর পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও এখনও খুঁজে ফিরছেন স্বজন হারানোর স্মৃতি। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য ঘাট ইজারাদারকে দায়ী করা হয়। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। দুর্ঘটনাস্থলে একটি সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও, তা বাস্তবায়ন হয়নি। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবারের স্বজনরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে ৮০ জনের মতো মানুষ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছুদূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করে। এ সময় মাঝি নৌকাটি ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে নৌকা ডুবে যায়। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতরে তীরে ওঠেন। স্থানীয় লোকজনও উদ্ধারকাজে যোগ দেন। পরে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস টানা চার দিন ধরে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন। প্রথমদিনে ৪৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে ২২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পঞ্চম থেকে ১৮তম দিনে আরও তিন জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। শেষ পর্যন্ত ৭১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। একজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি হলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৩)। তার বাড়ি উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায়।

আউলিয়া ঘাট এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট দিয়ে নৌকায় হাজারো মানুষের চলাচল। করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে বোদা উপজেলার মাড়েয়া, শালডাঙ্গা, সাকোয়া, বেংহারি বনগ্রাম ইউনিয়ন। পূর্ব পাড়ে বড়শশী, কালিয়াগঞ্জ ও চিলাহাটি ইউনিয়ন। বড়শশী ইউনিয়নে রয়েছে বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির। নদীর দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। প্রতি বছর আশপাশের কয়েক জেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উৎসবে যোগ দেন। সেইসঙ্গে স্থানীয়রা যাতায়াত করেন। এজন্য আউলিয়া ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের দাবি এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের। নৌকাডুবির মর্মান্তিক ঘটনার পর এখানে সেতু নির্মাণের দাবি জোরালো হয়। এ অবস্থায় রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এই ঘাটে ওয়াই আকৃতির একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। সে অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারা সেতু নির্মাণের মাপ নেন। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি।

প্রতি বছর আউলিয়া ঘাট ইজারা দেয় জেলা পরিষদ। এ বছর ছয় লাখ ৫২ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হান্নান শেখ বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য ঘাটের ইজারাদারকে দায়ী করা হয়েছে। সেইসঙ্গে মাঝির অদক্ষতা, ধর্মীয় কুসংস্কারসহ যাত্রীদের অসচেতনতাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া এই জাতীয় দুর্ঘটনা এড়াতে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে যাত্রীদের জন্য লাইফ জ্যাকেট, দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ, আধুনিক নৌযান ব্যবহার, ঘাট পরিদর্শক রাখা এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তবে এটা সত্য, এখন পর্যন্ত কোনও সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। ওই ঘাটে সেতু নির্মাণ হলে ছয়-সাত ইউনিয়নের মানুষের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জেলা পরিষদের অধীনে খেয়াঘাট ইজারার শর্ত অনুযায়ী যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কিন্তু ইজারাদার কোনও উদ্যোগ নেননি। আগের মতোই জরাজীর্ণ নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। যাত্রী ওঠানামার জন্য ঘাট স্থাপন করা হয়নি। লাইফ জ্যাকেট নেই। ইজারাদারের গাফিলতির পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা এখনও রয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আবারও নৌকাডুবির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এক বছর আগে পঞ্চগড়ে নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন স্থানীয়রাও

স্থানীয় পরিবেশকর্মী সরকার হায়দার বলেন, ‘এখনও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনায় চলছে আউলিয়া ঘাটে যাত্রী পারাপার। এত বড় দুর্ঘটনার পরও কোনও নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়মনীতি বাধ্যতামূলক করা উচিত। ঘাটগুলো কীভাবে চলবে, নৌযানগুলো কেমন হবে, কোন যন্ত্রের সাহায্যে চলবে, সবোর্চ্চ যাত্রী কতজন থাকবে, জনবল কাঠামো কেমন হবে—এগুলো নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। একইসঙ্গে নৌযানে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত, ঘাট পরিদর্শক এবং নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষক থাকাও জরুরি। সবমিলিয়ে ঘাট ও নৌযানগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আউলিয়া ঘাটের ইজারাদার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘নতুন নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। শ্যালোইঞ্জিন কিনেছি আমরা। এগুলোতে লাইফ জ্যাকেট থাকবে। প্রতি যাত্রী ১০ টাকায় এবং ২০ টাকায় মোটরসাইকেল পারাপার করা হচ্ছে। মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয়। সমস্যাগুলো নিরসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

পুলিশ জানায়, নৌকাডুবির ঘটনায় চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিন জনকে আসামি করে মামলা করেন নৌ অধিদফতরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান। গত ১৪ মার্চ ঘাটের তখনকার ইজারাদার আবদুল জব্বার ও ডুবে যাওয়া নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়াকে গ্রেফতার করে বোদা থানা পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে। মামলার অপর আসামি আরেক মাঝি রবিউল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

দুর্ঘটনার পর ঘাটের কোনও উন্নয়ন না হওয়ায় এবং আগের মতো অবস্থা থাকায় এবার মহালয়া উৎসবের আয়োজন করা হবে না বলে জানালেন বদেশ্বরী মন্দির কমিটির সভাপতি নীতিশ কুমার বকসি ওরফে মুকুল বকসি। তিনি বলেন, ‘এবার মহালয়ার অনুষ্ঠান ১৪ অক্টোবর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে উৎসব হবে না। শুধু পূজা-অর্চনা করা হবে। এ বছর আমরা কোনও ধরনের প্রচার করবো না। কোনও পোস্টার, চিঠিপত্র ছাপাবো না। আয়োজন হবে সীমিত। যদি এরপরও ভক্তরা আসেন তাদের পূজা-অর্চনা করতে হবে। যতদিন ওই ঘাটে সেতু না হবে, ততদিন সীমিত আকারে মহালয়া অনুষ্ঠান হবে। তবে উৎসব হবে না।’

বদেশ্বরী মন্দির কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হরিদাস চন্দ্র রায় বলেন, ‘নৌকাডুবির ঘটনার পর ভারত সরকারের অর্থায়নে ৬৮ লাখ টাকায় মন্দির এলাকায় তিনতলা বিশিষ্ট সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার সেন্টার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেখানে হলরুম, কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, লাইব্রেরি ও গেস্টরুম নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে একতলা ভবনে হলরুম নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া অনাথআশ্রম খোলা হয়েছে। বর্তমানে ১০ জন অনাথ রয়েছে আশ্রমে।’

ইজারাদারের গাফিলতির পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা এখনও রয়ে গেছে

সেতু নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) পঞ্চগড়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদ জামান বলেন, ‘আউলিয়ার ঘাটে সেতু নির্মাণের দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। জাতীয় ক্রয় কমিটি থেকে অনুমোদনের পর ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হবে। অল্প সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।’

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন মাস্টার তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘আমরা পুরো বিষয়টি তদন্ত করে, তার প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে দিয়েছিলাম। প্রতিবেদনের আলোকে তারা ব্যবস্থা নেবেন বলেছেন। প্রতিবেদনে কী কী উল্লেখ করা হয়েছে, তা সাংবাদিকদের জানানোর কথা ছিল জেলা প্রশাসকের। আমি এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’ 

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম একটি দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জেলা পরিষদকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে। পরে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা এবং বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায়কে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।

/এএম/
সম্পর্কিত
বেল পাড়া নিয়ে সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিহত
গাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চার শতাধিক ইসরায়েলি হামলা
বৃষ্টিতে লবণ তুলতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারালেন দুই শ্রমিক
সর্বশেষ খবর
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
এসএসসি’র ফল প্রকাশের দিন ঘোষণা
এসএসসি’র ফল প্রকাশের দিন ঘোষণা
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক